জুকুভ্যালি ভ্রমণ-

নাগাল্যান্ড ও মণিপুর রাজ্যের সীমান্তে জুকু (Dzukou) ভ্যালি এক মনোরম সৌন্দর্যৈর ডালি নিয়ে অবস্থিত। প্রায় সব ঋতুতেই বিভিন্ন ফুলের সমারোহ। ২৪০০ মিটার উঁচুতে নাগাল্যান্ড আর মনিপুরের বেশ কিছু অংশ মিলিয়ে এই উপত্যকা। পিছনেই নাগাল্যান্ডের জাফু পর্বত। দুষ্প্রাপ্য জুকু লিলি এখানে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। ভ্যালির ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে বয়ে গেছে একটা সরু স্ট্রীম, যা জুকু এবং জাপফু এই দুই নদীর মিলিত প্রবাহ। অসংখ্য বাহারি ফুলের মেলা বসে রোজ তার দুই পাড়ে। সেই মেলায় শরিক হতে প্রজাপতি নেমে আসে, রামধনু ডানা পিঠে নিয়ে। মেঘ ছুঁয়ে মাখামাখি হয় তার রঙে।

জুকু কথাটি আংগামি নাগাদের (ভিস্যেমা উপভাষা) ভাষায় হল ‘আত্মা’হীন ও ‘নিস্তেজ’ (Soulless & dull)। কারণ ভিস্যেমাদের পুর্বপুরুষেরা এখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে বিফল হন। ফসল ফলানোর জন্য আবহাওয়া ছিল বিরূপ আর ঠান্ডার প্রকোপ। জুকু ভ্যালির অধিকাংশটাই মণিপুর রাজ্যের। এই নিয়ে টানাপড়েন চলছে নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের মধ্যে।

জুকুভ্যালি ট্রেক

যারা কখনও ট্রেকিং করেনি, কিন্তু ভাবছে শুরু করবে, তাদের জন্য নাগাল্যান্ড এর জুকু ভ্যালি আদর্শ জায়গা বিলো এভারেজ ওয়াকার’রাও ৪ ঘণ্টার মধ্যে এই ট্রেক শেষ করে নিতে পারে। অন্যান্য ট্রেকের মতো রোজ মাইলকে মাইল হাঁটাও নেই এখানে।

  • জুকুভ্যালি পৌঁছানোর দু’টো ট্রেল। বিশ্বেমা এবং জাখামা। বিশ্বেমা ট্রেল ধরে উঠলে বিগিনারদের সেরকম কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুরুর দিকে ১:৩০ ঘণ্টা খাড়াই পথ হলেও, পুরোটা পথ পাথরের সিঁড়ি বিছানো। তাই খাড়াই পথ ও সহজ হয়ে যায়। জাখামা ট্রেল অপেক্ষাকৃত কঠিন। পুরোটাই খাড়াই এবং রাস্তা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রচুর। যদি দু’টো ট্রেলই এক্সপ্লোর করতে চায় কেউ তবে জাখামা দিয়ে উঠে বিশ্বেমা দিয়ে নামা অপেক্ষাকৃত সেফ।
  • ভারতবর্ষের অন্যান্য যে কোনো পাহাড়ি এলাকার ভ্যালিগুলোর সাথে নাগাল্যান্ড এর ভ্যালির একটা পার্থক্য আছে। ছোট ছোট বাঁশগাছ দিয়ে ঢাকা থাকায় পাহাড়গুলো বছরের অধিকাংশ সময়ই সবুজ হয়ে থাকে। চট করে দেখলে মনে হয় যেন একটা আদিম সভ্যতা সারাগায়ে সবুজ রঙের আবির মেখে, পাহাড় সেজে বসে আছে। বৃষ্টি আসে, ভিজে যায় তার শরীর। কিন্তু তার রং মোছেনা, বরং গাঢ় হয়ে যায় আরও।
  • বাড়ির পাশে যদি এমন কিছু থাকে যা পৃথিবীর অন্য কোত্থাও নেই, তা সামনে থেকে চাক্ষুষ না করলে, মনটা কেমন একটা উসখুস উসখুস করেনা? জুকু লিলি। মাটির দিকে মাথা নিচু করে ফুটে ওঠা লিলির এই প্রজাপতিটির যেন বহু অভিমান সূর্যের ওপর। যেন পৃথিবীতে এক এবং অনন্য হয়েও অহংকার তাকে ছোঁয়ার স্পর্ধা পায়নি কক্ষনও। যেন একটা গোলাপি আভা কোনো স্বর্গীয় অপ্সরার শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে সারা ভ্যালিতে। আর এই লিলি, একমাত্র জুকু ভ্যালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোত্থাও নেই।

  • দ্য ভ্যালি– মনিপুর আর নাগাল্যান্ড এর সীমান্তে অবস্থিত জুকুভ্যালি। ভ্যালির ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে বয়ে গেছে একটা সরু স্ট্রীম, যা জুকু এবং জাপফু এই দুই নদীর মিলিত প্রবাহ। অসংখ্য বাহারি ফুলের মেলা বসে রোজ তার দুই পাড়ে। সেই মেলায় শরিক হতে প্রজাপতি নেমে আসে, রামধনু ডানা পিঠে নিয়ে। মেঘ ছুঁয়ে মাখামাখি হয় তার রঙে। আর কিছু প্রাকৃতিক গুহা, ট্রেলের দিকে চোখ মেলে বসে থাকে আজন্মকাল। যেন কারোর অপেক্ষা করছে সে। যেন প্রত্যেকটা ট্রেকার কে সে বলছে, ‘এসো বন্ধু। তোমার শহরের স্যাঁতস্যাঁতে দু’কামরা, ঘ্যানঘ্যানে চাকরি, প্যানপ্যানে জীবন আর ঘিনঘিনে রাস্তা ভুলে, দু’টো দিন এসো। আমার বুকে আশ্রয় নাও’। আপনি হেঁটে যেতে যেতে ওদের এসব কান্ড কারখানা দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে যাবেন ভ্যালির একদম শেষতম প্রান্তে, তা টের ও পাবেন না। যার পরেও ভ্যালি বিস্তৃত বহুদূর, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা বানায়নি কেউ। সেখানেই দেখা যায় একটা সাদা রঙের প্রায় দু’তলা উঁচু ক্রস। যার পাশেই একটা বোর্ডে লেখা আছে ‘এখানেই থামো বন্ধু। এরপরের প্রকৃতি শুদ্ধ।’

  • নাগা সংস্কৃতি- এই ট্রেকের একটি অন্যতম টপআপ হলো নাগা কালচারকে জানতে পারা। একবার ভাবুন শুধু, আপনার হোমস্টের হোস্ট আপনাকে নিয়ে পৌঁছে গেছে তার গ্রামে। তার বাড়ির ভিতরে রান্নাঘরে বসে চা খেতে খেতে আপনি দেখছেন তার ৭৫ ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা মা, তাকিয়ে আছেন আপনার দিকে জুলুজুলু চোখে। বাড়ির ছোটছোট কুঁচোকাঁচারা আপনাকে দূর থেকে আড়চোখে দেখে হুটোপাটি করে পালিয়ে যাচ্ছে লজ্জা পেয়ে। তারপর সেই হোস্ট কখনও তার বাগানের গাছ থেকে আপনার হাতে পেরে এনে দিচ্ছে পাহাড়ি মিষ্টি ফল। আবার কখনও তাদের জাপানের সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস বোঝাচ্ছে। কোনো গ্রামের গেটের বিভিন্ন অদ্ভুত অদ্ভুত স্কাল্পচারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে কোন মুকুটের কি রহস্য। গ্রামের মোড়লের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে সে বোঝাচ্ছে কেন সেই বাড়ির মাথায় লম্বা একটা কাটা চিহ্ন বর্তমান। আবার কখনও সরু আলপথ ধরে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের প্যাডিফিল্ডে। এসবই যেন স্বপ্নের কারখানা। যা জুকুভ্যালির জন্য রওনা না দিলে আপনার অধরা থেকে যাবে।

  • দ্য ডর্ম – জুকু ভ্যালির টপে থাকা একমাত্র ডর্মিটোরিকে আরামসে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটিতে ফেলাই যায়। ভাবুন তো দেশ বিদেশ থেকে আসা নানান জাতের, নানান ক্লাসের, নানান রঙের, নানান ভাষার কিছু মানুষ এই জায়গাটায় এসে একসাথে থাকে। কারণ, প্রকৃতির কাছে মানুষের কোনো বিভেদ নেই। তাই, যে জার্মানির সুপারনোভা তন্বী তার দেশে রোলস রয়েল বা ফেরারী চালায় এবং যে বাংলাদেশের ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে বাস ভাড়া বাঁচিয়ে বা টিফিন না খেয়ে টাকা জমিয়ে, এই ভ্যালিতে এসে পৌঁছায়, তারা দু’জনেই সারাদিন ভ্যালিতে প্রজাপতির মতো উড়ে, রাতে ৫০টাকা দিয়ে ম্যাট্রেস ভাড়া করে ডর্মের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে পাশাপাশি।

জুকুভ্যালি ট্রেকের প্লাস পয়েন্টস

  • জুকুভ্যালি কে চাইলেই উইকেন্ড ট্রেক বানিয়ে ফেলা যায়। শুক্রবার সকাল সকাল কোনো ফ্লাইটে চেপে নেমে যান ডিমাপুর। তারপর ডিমাপুর থেকে কোহিমাগামী একটা শেয়ার ট্যাক্সিতে উঠুন। রাস্তা মধ্যখানে অল্প খারাপ হলেও ৬ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কোহিমা বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে আবার একটা শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে ১ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কিগওয়েমা গ্রামে। বিকাল ৩-৪টের মধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেলে একটুও সময় নষ্ট না করে ২ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে ঘুরে আসতে পারেন নাগা হেরিটেজ ভিলেজ।

  • রাতটা কাটান কিগওয়েমা গ্রামেই যেকোনো হোম স্টে’তে। বিশ্বাস করেন, নাগাপুরী রান্নার স্বাদ কলকাতার আর্সালান কে, বলে বলে ১০ গোল মারতে পারে। রাতটা লেপের তলায় কাটিয়ে, শনিবার ভোর ভোর (৬টা নাগাদ) রওনা দিন বিশ্বেমা বা জাখামার উদ্দেশ্যে। যেকোনো শেয়ার্ড ট্যাক্সি বা রিজার্ভ করা গাড়ি নিয়ে (বিশ্বেমা থেকে ট্রেক শুরু করলে গাড়ি রিজার্ভ করে নেওয়া ভালো। কারণ বিশ্বেমার ট্রেকিং পয়েন্ট মেন রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে)। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন ড্রপ পয়েন্টে।

  • দুপুর ১২টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন জুকুভ্যালিতে। বিকেল অব্দি ভ্যালিতে স্বর্গের ছোঁয়া নিয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিন ভ্যালির টপে থাকা ডর্মে। রবিবার দিন ভোরবেলা গরম চা খেতে খেতে একপ্রস্থ ভ্যালির দিকে চোখ বুলিয়ে রওনা দিন সমতলের দিকে। রবিবার দিনেই ডিমাপুর থেকে সন্ধ্যা বেলার কোনো ফ্লাইটে চেপে বাড়ি ফিরে আসুন। হ্যাঁ একটু হেকটিক হবে মানছি, কিন্তু ওই যে বলে ‘টোটালি ওয়ার্থ ইট’।

  • শেয়ার গাড়ি যদি আপনার ট্রান্সপোর্টেশন মিডিয়াম হয় এবং যাতায়াতের মাধ্যম যদি ট্রেন হয়, তবে এই ট্রেককে আপনি অনায়াসেই পকেট ফ্রেন্ডলি উপাধি দিতেই পারেন। এসি বাস, লোকাল বাস, শেয়ার ট্যাক্সি, শেয়ার সুমো সমস্ত অপশন হাতের কাছে থৈ থৈ করে। আর ভ্যালিতে প্রতিদিন থাকা খাওয়া নিয়ে খরচ মাথা পিছু মাত্র ৬০০টাকার মধ্যে।
  • গাইডের কোনো প্রয়োজন এই ট্রেকে হয়না। ট্রেকের একটা বেসিক আইডিয়া গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে নিয়ে নিলেই, আরামসে পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে।

জুকুভ্যালি ট্রেকের মাইনাস পয়েন্ট

একটাই, একবার পৌঁছে গেলে কিছুতেই ফিরে আসতে মন চাইবেনা।

ভ্রমণ খরচ

মাথাপিছু কোলকাতা থেকে কোলকাতা খরচ ১২,০০০ (ফ্লাইট এবং 3AC ট্রেন ভাড়া নিয়ে) । সময় ৭ দিন।

পারমিট

নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা না হলে বা তবে নাগাল্যান্ডে প্রবেশের জন্য ইনার লাইন পারমিট আগে থেকে নিয়ে যেতে হবে অথবা ডিমাপুর বা কোহিমা ডিসি কোর্ট থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এই পারমিট যে কেউ খুব সহজে কোলকাতার নাগাল্যান্ড হাউস থেকে ৫০.০০/পারমিট এর বিনিময় করিয়ে নিতে পারবে।সাথে ভোটার বা আধার কার্ডের দুটো কপি নিয়ে গেলেই হয়ে যায়।

প্রয়োজনীয় তথ্য

ট্রেক করবার সময় অবশ্যই নিজের জল, হাল্কা খাবার, ফল, প্রয়োজনীয় ওষুধ সাথে রাখতে হবে। শীতকালে গেলে সাথে উপযুক্ত গরম পোশাক রাখতে হবে রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়ে। বর্ষাকালে গেলে সাথে বর্ষাতি রাখতে হবে। টর্চ অবশ্যই রাখতে হবে। পুরো জায়গা প্লাস্টিক মুক্ত।

জুকুভ্যালি ভ্রমণের সেরা সময়

জুকু ভ্যালিতে যাওয়ার সেরা সময় বর্ষা কাল। এক মাত্র বর্ষাতেই ভ্যালিতে বসে সকল ধরনের লাল নীল হলুদ সাদা ফুলের মেলা।  জুকু লিলি রাস্তার পাশে ফোটে থাকে স্বপ্নের মতো। স্বপ্নমাখা নীল আকাশের নিচে পাহাড় যেনো সবুজের রাজ্য। ভ্যালির ভিতরে মেঘেদের আনাগোনা হয় ঘনবর্ষায়। তাই জুন-জুলাই ট্রেকের আদর্শ সময়।   

জুকুভ্যালি পৌঁছানো


কলকাতা থেকে ট্রেনে ডিমাপুর অথবা ফ্লাইটে কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট ডিমাপুর বা গৌহাটি হয়ে ডিমাপুর পৌঁছে যাওয়া যায় অনায়াসেই। ডিমাপুরে নেমে সোজা চলে যান ডিমাপুর স্টেশন সংলগ্ন শেয়ার ট্যাক্সি বুথে যেখানে মাথাপিছু ৩০০ টাকায় শেয়ার গাড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে সোজা কোহিমা AOC স্ট্যান্ড। সেখান থেকে আবার একটা শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে ১ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কিগ্বেমার ডন হোমস্টের সামনে।

কোথায় থাকবেন

জুকু ভ্যালিতে থাকার জন্য ট্রেকার’স হাট ছাড়া আর কোন ব্যাবস্থা নেই। কোহিমা থেকে ভিসামার দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। ভিসামাতে কিছু হোমস্টে আছে।

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার।। হ্যাপি_ট্রাভেলিং

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ