শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ-
শ্রীমঙ্গল (Sreemangal) কে বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী বলা হয়। শ্রীমঙ্গল চায়ের জন্য বিখ্যাত একথা সকলেই জানেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে শ্রীমঙ্গলের চা বাগান বিস্তৃত। শ্রীমঙ্গলে রয়েছে দেশি-বিদেশি কোম্পানির ছোট-বড় প্রায় ৪৪টি চা বাগান। মাইলের পর মাইল জুড়ে চা বাগান দেখে মনে হয় পাহাড়ের ঢালে সবুজ গালিচা। ছোট বড় উঁচু-নিচু টিলা আর হরেক রকম গাছ- গাছালি। টিলার পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা সড়ক। সড়কের কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। দেশের ভেতর অন্যরকম এক দেশ। চায়ের দেশ, মেঘের দেশ, বন-বনানী, টিলা আর হাওরের দেশ এ শ্রীমঙ্গল। মসৃন সবুজ চা–বাগানের গালিচায় ছাওয়া উঁচু–নিচু পাহাড়ী টিলা, বনভূমি, চিড়িয়াখানা, গিরিখাদ, লেক, হাওর, ঝর্না কি নেই এখানে! গোটা শ্রীমঙ্গল যেন বৈচিত্রময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি। যেখানে বাস করে অনেকগুলো নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাইতো শ্রীমঙ্গলের রুপে বিমুগ্ধ কানাডিয়ান লেখক এন্টনি আর ডেল্টন একে “একখন্ড স্বর্গ” বলে আখ্যয়িত করেছেন। এখানকার বেশকিছু চা বাগানের নজরকাড়া সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে চলেছে। এখানকার মাইলের পর মাইল বিস্তৃত চা বাগান দেখে মনে হবে যেন পাহাড়ের ঢালে সবুজ গালিচা বিছানো রয়েছে। দেশের সবচেয়ে উন্নতমানের চা এখানেই উৎপন্ন হয়ে থাকে।
শহরের প্রবেশদ্বারে আপনাকে স্বাগত জানাবে চাকন্যা ভাস্কর্য। চা বাগানের লেকগুলোর সৌন্দর্যও উপভোগ্য। আর চা-বাগানের মনোরম দৃশ্য পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করে তুলে। নজরকাড়া সব মনমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে লোকজন ছুটে আসে চারদিক থেকে। শীতের শুরুতেই পর্যটকরা ভিড় করতে শুরু করে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। পাহাড় এর কোলঘেঁষা সবুজময় শতবর্ষী চা বাগান যেনো প্রকৃতির অনন্য রূপ। শ্রীমঙ্গলের বৈচিত্র্যময় এসব স্থান দেখতে দূরদেশ থেকেও পর্যটকরা ছুটে আসেন। দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি ছড়া,চা বাগান, বনাঞ্চল, নীল জলরাশির হাওর সমৃদ্ধ শহর শ্রীমঙ্গল অপরূপ সৌন্দর্যেরই লীলাভূমি। এখানে চা বাগানই সাধারণ ভ্রমনার্থীদের কাছে সবচে’ বড় আকর্ষণ। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। এ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে বেড়ানো যায় বারো মাসজুড়েই।
কি কি দেখবেনঃ
এখানে যেমন বনভূমি রয়েছে; তেমনি রয়েছে হাওর আর বিল। পাশাপাশি আদিবাসী খাসিয়া, মণিপুরী, গারো, টিপরা-এদের বাড়িঘরও রয়েছে। চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদের সাথে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারাদেশের। চা, রাবার, লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠের জন্য শ্রীমঙ্গলের খ্যাতি ব্যাপক। দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদভারে সারাবছর মুখরিত থাকে। শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করার সময় দেখা যাবে চা কন্যা ভাস্কর্য। যা আপনার মনটা প্রথমেই কেড়ে নেবে সে জায়গা। জেলা প্রশাসন ধারা এই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে। আর চা বাগান রয়েছে ইংরেজদের কিছু স্মৃতি। যাত্রাপথে ইংরেজ আমলের কিছু নিদর্শন দেখা যায়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানঃ
জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণি ও নান্দনিক সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মিশ্র চিরহরিৎ এ বনভূমিতে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির জীব। রয়েছে ১৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি, ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি।
পৃথিবীর যে চারটি দেশে বিপন্ন প্রজাতির উল্লুক দেখা যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ উল্লুকের বৃহত্তম আবাসস্থল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পাখি দেখার জন্যও এটি যেন এক স্বর্গোদ্যান। তাই জায়গাটি শুধু এখন পর্যটক আকর্ষণই নয়, রীতিমতো প্রাকৃতিক গবেষণাগার। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা গবেষকরা গবেষণার জন্য এখানে আসেন।
উদ্যানের পাশেই রয়েছে দুটি খাসিয়া পুঞ্জি। তাদের আবাসস্থল টিলার ওপর এবং জীবিকা পান চাষ। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে লাউয়াছড়ার অবস্থান। লাউয়াছড়া যাওয়ার পথে চোখে পড়বে বধ্যভূমি-৭১, নয়নাভিরাম চা বাগান, টি রিসোর্ট, লেবু বাগান, আনারস বাগান প্রভৃতি। লাউয়াছড়ার প্রবেশ পথে শুনতে পাবেন ঝিঁ-ঝিঁ পোকার অবিরাম শব্দ এবং গাছে গাছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করতে প্রাপ্তবয়স্কদের ২০ টাকা, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ছাত্রছাত্রীদের ১০ টাকা, পিকনিক স্পটে প্রতিজন ১০ টাকা এবং বিদেশিদের ৫ ডলার পরিশোধ করতে হয়। প্রবেশ পথে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। উদ্যান ঘুরে দেখার ক্ষেত্রে কিছু করণীয় ও বর্জনীয় রয়েছে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
হাইল হাওরঃ
শ্রীমঙ্গলের সুবিশাল হাইল হাওরের নীল জলরাশি, বিভিন্ন রঙের পদ্মফুল ও মাছের খেলাও কম আকর্ষণীয় নয়। হাইল হাওরের অভ্যন্তরে ১০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে বাইক্কা বিল অবস্থিত। এ বিল শুধু মাছের জন্যই নয়, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণির জন্যও নিরাপদ আবাসস্থল। শীতে বাইক্কা বিলেই বসে অতিথি পাখিদের মিলনমেলা। ডিঙি নৌকায় চড়ে বাইক্কা বিলে ঘুরে বেড়ানো মনে এনে দেবে স্বর্গীয় অনুভূতি।
মাধবপুর লেকঃ
শ্রীমঙ্গলের আরেকটি আকর্ষণ মাধবপুর লেক। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। লেকটি কমলগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত হলেও শ্রীমঙ্গল থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটক স্থানটি দেখতে যান। ছবির মতো সুন্দর এই মনোরম লেকের জলে রয়েছে গোল গোল পাতা আর তারই ফাঁকে ফাঁকে ফুটে রয়েছে নীলপদ্ম। এখানে অবস্থানকালে নাম না জানা বুনো ফুলের মৃদু ঘ্রাণ আপনার মনকে প্রফুল্ল করবে।
অন্যান্যঃ
শ্রীমঙ্গল শহরের মিশন রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশন এখানকার অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ। একসময় এটি সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা নামে পরিচিত ছিল। এখানে গেলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণি। দেশের যেকোনো স্থান থেকে সড়ক ও রেলপথে সহজেই শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। থাকার জন্য এখানে রয়েছে হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউস। কম খরচে থাকার জন্যও হোটেল আছে। শীতকালে অগ্রিম বুকিং দিলে ভালো হয়।
শ্রীমঙ্গল দর্শনীয় স্থান সমূহ
- বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট।
- বাংলাদেশ চা বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট।
- ৪০ টি চা বাগান।
- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
- নির্মাই শিববাড়ী।
- বিভিন্ন খাসিয়া পুঞ্জি।
- হাইল হাওরে বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম।
- সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা।
- কাছারী বাড়ী। (সহকারী কমিশনার ভূমি কার্যালয় সংলগ্ন)
- মসজিদুল আউলিয়া
- রমেশ রাম গৌড় এর ৭ কালারের চা
- শ্যামলী পর্যটন
- মাধবপুর লেক
- রাবার বাগান
- আনারস বাগান
- লেবু বাগান
- ভাড়াউড়া লেক
- রাজঘাট লেক
- মাগুরছড়া গ্যাসকূপ
- পান পুঞ্জি
- ওফিং হিল
- বার্নিস টিলার আকাশ ছোয়া সবুজ মেলা
- শ্রীমঙ্গলের এক মাত্র ঝর্ণা ‘‘যজ্ঞ কুন্ডের ধারা’’
- শতবর্ষের স্মৃতি বিজড়িত শ্রীমঙ্গলে ডিনস্টন সিমেট্রি
- মসজিদুল আউলিয়া
- টি রিসোর্ট
- আরোগ্য কুঞ্জ
- হরিণছড়া গলফ কোর্ট
- ডলু বাড়ি টিপরা পল্লী
- উচু-নিচু পাহাড়
ভ্রমণের সময়ঃ
এলাকায়ঘুরতে আসলে সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাসে আসা ভালো। কেননা মে থেকে অক্টোবর মাসে পাতা সংগ্রহের কাজ চলে। আর তাছাড়া আপনার ইচ্ছামতো যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন এবং খাবেনঃ
শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য অনেক রিসোর্ট বা হোটেল রয়েছে। আপনি সেখানে গিয়ে যে রিসোর্ট বা হোটেল উঠবেন, সেখানেই খেয়ে নিতে পারেন। এর আশেপাশে অনেক ছোট মাঝারি ধরনের রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফে রয়েছে। ক্ষুধা লাগলে সেখানে খেয়ে নিতে পারেন। এখানে গিয়ে বিভিন্ন রকমের চা অবশ্যই নিয়ে/খেয়ে আসবেন।
চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল যাবেন অথচ সাত রং চায়ের স্বাদ নেবেন না, তা কী করে হয়! একই গ্লাসের মধ্যে স্তরে স্তরে সাজানো সাত রং চা! তরল পানীয়কে কীভাবে সাত স্তরে সাজানো সম্ভব! ব্যাপারটি বিস্ময়েরই বটে। অর্ডার করলে গোপন ঘরে প্রস্তুত তৈরির পর সেই চা আপনাকে পরিবেশন করা হয়। প্রতি কাপের মূল্য ৭০-৯০ টাকা।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে দূরত্বঃ ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল চা বাগান এর দূরত্ব ২৪৫ কিমি।
যাতায়াতঃ
ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে সহজেই শ্রীমঙ্গল যাওয়া যাবে। ট্রেনে ভালো কিছু সার্ভিস রয়েছে।
যেমন আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস মঙ্গলবার সারা সপ্তাহে ছয় দিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। প্রতিদিন দুপুর বারোটায় ছেড়ে যায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। কলনি এক্সপ্রেস বিকাল তিন টায় যাত্রা শুরু করে। এছাড়া আরো কিছু ট্রেন রয়েছে যেগুলো সাপ্তাহিক ছুটি বাদে প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল এর উদ্দেশ্যে ছুটে যায়। ট্রেনের টিকেট শ্রেণীভেদে ১৮৫টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি শ্রীমঙ্গলের বাস পাওয়া যায়। এগুলো বাস পাওয়া যায় সায়দাবাদ, মহাখালী, ফকিরাপুল থেকে। বাস গুলো হচ্ছে হানিফ, এনা, শ্যামলী ইত্যাদি।
শ্রীমঙ্গল থেকে চা বাগান ভ্রমণের জন্য যে কোন গাড়ি ভাড়া করলে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হবে। তাছাড়া সিএনজি ভাড়া করলে তা খরচ হবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার।। হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)