রোয়াংছড়ি ভ্রমণ–
রোয়াংছড়ি বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। পথিমধ্যে যতদূর চোখ যায় রাস্তার দু’ধারে ঢেউ খেলানো অসংখ্য পাহাড়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথ দিয়ে চান্দের গাড়ির যাত্রায় শান্ত প্রকৃতি পর্যটকদের অন্তরে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। দিগন্ত বিস্তৃত উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়ে ঘিরে থাকা অঞ্চল তার বিশালতা প্রমাণ করে। পাহাড়ের চূড়ায় গুচ্ছাকারে কিছু জমে থাকা মেঘ ধরা পড়ে চোখে। নীলগিরির পথের মতো স্বচ্ছ মেঘ এখানে খালি চোখে ধরা না দিলেও সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় সামান্য মেঘের স্তূপ ভ্রমণে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। চান্দের গাড়িতে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করলে ৩৬০ ডিগ্রি প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়। পাহাড়িদের পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা কলাগাছ, আখ, জুম চাষের ক্ষেত দেখে।
এছাড়াও রোয়াংছড়ি বাজারের পাশ ঘেঁষে নামলেই এক পাহাড়ি ছড়া। বর্ষায় এ ছড়া বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর থাকে। আর চড়ার বুকে ছড়িয়ে আছে অগণিত ছোট-বড় পাথর। দুই পাশে শুধুই ঝোপঝাড়ে আবৃত। কখনো কখনো এই ঝোপঝাড় খাড়া হয়ে উঠেছে। ছড়া পাড় হলেই পাহাড়ে ওঠা যায়। উঁচু-নিচু এই পাহাড়ি পথের দুই পাশে কখনো ঘাসের বন, আবার কখনো সেগুন গাছের বাগান দৃষ্টিগোচর হয়।
এই অঞ্চলে পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট জুমঘর চোখে পরে। চারপাশটা এক অপূর্ব দৃশ্যে পরিপূর্ণ। রাস্তা গুলো খাড়া হয়ে নিচের দিকে ঢালু হয়ে পড়েছে। আর রাস্তার ডান পাশে অদূরে উকিঁ দিচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং এর চূড়া। হাটঁতে হাটঁতে চলে যাওয়া যায় রনিন পাড়ার মুখে। রনিন পাড়ায় যেতে হলে রাস্তা দিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে যেতে হবে। বলার বাহুল্য যে রণিন পাড়াটি বেশ দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত হলেও বেশ সুন্দর এই অঞ্চল। এখানকার পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো আপনার উপভোগের সীমা বাড়িয়ে তুলবে।
এখানকার ছোট বড় এই শুভ্র পাহাড় গুলো দেখলে মনে হবে আমরা যেন এই পাহাড়েরই সন্তান। পাহাড়েই কাটছে আমাদের শৈশব, কৈশর আর যৌবন পাহাড়ের চূড়ায় বসে ক্লান্ত ও ক্ষান্ত এ মন বিশ্রামের জন্য মন মেতে উঠে। আর সকালে রোদের আলোতে পাহাড় গুলোর সৌন্দর্য বেড়ে যায় হাজারগুন। কি অপূর্ব দেখতে লাগে! দূর থেকে দেখলে মনে হয়, কেউ একজন শুভ্র পাহাড় গুলোতে সোনালী আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
নামকরণঃ
রখইং ছড়া যেখানে তারাছা খালে এসে মিশেছে, স্মরণাতীতকাল পূর্বে সেই রখইং ছড়ার মোহনায় মার্মা উপজাতিদের এক জনপদ গড়ে উঠে। রখইং ছড়ার তীরে এই জনপদ গড়ে উঠায় মারমা উপজাতিদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী স্থানীয় অধিবাসীরা এই জনপদকে ছড়ার নামে রখইং ওয়াহ্ নামে অভিহিত করে। রখইং ওয়াহ্ অর্থ রখইং ছড়ার মোহনা। কালক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরে এখানে পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম জেলা হতে বাঙালীদের আগমণ ঘটে। ছোট্ট পরিসরে এখানে বাজার গড়ে উঠে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আরাকানকে রোয়াং বলা হয়। তাই রখইং ওয়াহ্কে স্থানীয় বাঙালীরা রোয়াংছড়ি নামে অভিহিত করায় তা কালক্রমে প্রচলিত হয়ে উঠে।
রোয়াংছড়ির দর্শনীয় স্থানঃ
দেবতাখুমঃ
বান্দরবানের গহীনের এই খুম নিয়ে বিস্তারিত বলার আসলে কিছুই নাই, সকলেই এর ভয়াবহ সৌন্দর্য সম্পর্কে জানেন। বর্তমানে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে এই স্পট। এতো অল্প ট্রেকিং করে এরকম বুনো পাহাড়ি ঝিরি আর খুমের স্বাদ বোধ হয় আর কোথাও পাওয়া সম্ভব না।
শীলবান্ধা ঝর্ণাঃ
শীলবান্ধার আশেপাশে ঘুরলে ছোট বড় প্রায় ৫ থেকে ৬ টি ঝর্ণার দেখা মেলে। ঝর্ণার পানিগুলো বেশ স্বচ্ছ। দেখলেই গা ভিজিয়ে ক্লান্ত মনকে শীতল করে নিতে ইচ্ছে করবে। ঝর্ণার পাশেই ঝিরি ও পাইন্দু খাল। খালগুলোর স্রোতও অনেক বেশি। মাঝে মধ্যে বড় পাথর গুলোতে পানি সশব্দে আছড়ে পড়ছে। পাথরের উপরে অবির্ভুত পতিত পানির শব্দ এক মনোমুগ্ধকর আওয়াজ সৃষ্টি করে। ঝর্ণার একদিকে একটা মোটা বিশাল গাছ পড়ে যা এক পাথর থেকে আরেক পাথরে মিশেছে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ঝর্ণার উপরের অংশ সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে আছে। ঝর্ণার পাড়ে গেলে মনে হবে পানির দেয়ালে বন্দি আপনি। ঝর্ণার আশেপাশে অনেক বড় বড় পাহাড় আছে।
রিজার্ভ ফলস ট্রেইলঃ
অসম্ভব সুন্দর মুগ্ধতা ছড়ানো একটি ট্রেইল। ঝর্ণায় যেতে দারুণ এই ট্রেইল পাড়ি দিতে হয়, এই ঝর্ণার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, শেষের পথটুকু আপনাদের সাঁতরে পার হতে হবে। ইনি হচ্ছে লজ্জাবতী রূপসী কণ্যার মতো। অনেক তপস্যার পর তিনি দেখা দিবেন। শুধু ট্রেকিং করেই তাকে দেখতে গেলেই হবেনা, ঝিরি পার হবার পরও সাঁতার কেটে বাঁক ঘুরে আরো সামনে যেতে হবে। তবেই দেখা মিলবে।
সিপ্পি পাহাড়ঃ
দেবতাখুমের দু দিকে দালানের মতো প্রায় ১০০ মিটার খাড়া পাহাড়। যার নাম সিপ্পি পাহাড়। ঘন বন জঙ্গল আর খাড়া পাহাড়ের ফলে দিনের বেলায় ভিতরে আলো না পৌঁছানোর ফলে ভিতরটা অন্ধকারে ঘেরা থাকে। পরিবেশটা হয়ে ওঠে নির্জন ও ভুতুড়ে ভুতুড়ে ভাব। সিপ্পি আয়সুয়াং নামের ২৯৩৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই পাহাড়টি বান্দরবানের পূর্ব প্রান্তে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে মোটামোটি দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত।পাহাড়ের স্বাদ ও গন্ধে নিজে মিশে যেতে চাইলে পায়ে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়।
রনিন পাড়াঃ
বান্দরবনের পাহাড় চুড়া সিপ্পি বা আরসুয়াং জয় কিংবা বৃহৎ ঝর্ণা তিনাপ সাইতার ভ্রমণের বেস ক্যাম্প বলা চলে এই রোনিন / রনিন পাড়াকে। রোনিন পাড়ায় মূলত বম ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস।প্রকৃতির সন্তান এখানকার মানুষদের সাথে মিশলে যে কারো ভালো লাগবে এটা নিশ্চিৎ। বান্দরবান পৌঁছে বাস থেকে নেমে রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে যেতে হবে রোয়াংছড়ি। সেখান থেকে গাইড নিয়ে ২৩ কিমি পাহাড়ি পথ হেঁটে পাইক্ষ্যাং পাড়া হয়ে যেতে হবে রোনিন পাড়ায়। অন্য পথে গেলে বান্দরবান থেকে রুমা হয়ে মুন্নুয়াম পাড়া হয়ে রনিন পাড়ায় যেতে হয়। মুন্নুয়াম পাড়ার পথটা অবশ্য দূরত্ব একটু বেশী হয়। তবে যেই পথেই যান না কেন মোটামুটি একটা দিন তো লেগেই যাবে। খুব ভালো ট্র্যাকার হলে হয়তো কিছুটা সময় বাঁচানো যাবে।
রামজাদী মন্দিরঃ
পর্যটন নগর বান্দরবনের মুকুটে নতুন পালক রামজাদি মন্দির। বান্দরবন-রোয়াংছড়ি সড়কের হদাবাবুর ঘোনায় পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে রামজাদি। মূল শহর থেকে ইজিবাইক বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মন্দিরে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। কয়েক শ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাঁধানো চত্বর পার হলেই বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া সাদা-সোনালি কারুকার্যের অপূর্ব মন্দির। বান্দরবনের আরেক বিখ্যাত মন্দির স্বর্ণজাদির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি এর উচ্চতা। ১২ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলার পর ১০ ফেব্রুয়ারি এটি পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই রামজাদির সৌন্দর্য দেখতে ছুটছেন পর্যটকেরা। পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত এই মন্দিরের স্থপতি মিয়ানমারের উসান উইন। গুরু ভান্তে হিসেবে খ্যাত স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা উপঞা জোত মহাথের এই মন্দিরেরও প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৪ সালে রামজাদির নির্মাণ শুরু হয়েছিল। বহু বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে পুণ্যার্থীদের দান ও স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মূল জাদি (মন্দির) ছাড়াও এখানে আরও ২৭টি ছোট জাদি রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির উচ্চতা ২১ ফুট। মূল জাদি ও সহজাদিগুলোতে পুণ্যার্থীদের দান করা ১ হাজার ৬১টি বুদ্ধমূর্তি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি দন্ডায়মাণ শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূতি রয়েছে।
তিনাপ সাইতারঃ
বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ জুড়ায় সবার। অসংখ্য পাহাড়, ঝরনা, বন, পশু-পাখির সঙ্গে সাক্ষাৎ মেলে বান্দরবানে। সেখানকার বিভিন্ন জলপ্রপাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো তিনাপ সাইতার। তিনাপ সাইতার হচ্ছে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে অবস্থিত একটি জলপ্রপাত। তিনাপ সাইতার একটি বম শব্দ। বম ভাষায় তিনাপ অর্থ নাকের সর্দি এবং সাইতার অর্থ ঝর্ণা বা জলপ্রপাত। এটি পাইন্দু খালে অবস্থিত।পানিপ্রবাহের দিক থেকে তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের সব থেকে বড় জলপ্রপাত। এটা পাইন্দু খালের অনেক ভেতরে অবস্থিত। তিনাপ সাইতারে যাওয়ার পথের ঝিরিপথ খুবই আকর্ষণীয়। বর্ষামৌসুমে তিনাপ সাইতারে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অন্যান্য দর্শনীয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে তিনাপ সাইতার অনেকটাই ভিন্ন। সব মৌসুমেই এ ঝরনার পানি স্বচ্ছ এবং ঠান্ডা-গরম থাকে। এ পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে আঁকাবাঁকা পথে ১৫০ ফুট উঁচু থেকে এ ঝরনার পানি পড়ে পাইন্দু খালে। সেখানে একেবারেই স্বচ্ছ পানিতে আপনি খালের তলদেশ পর্যন্ত দেখতে পারবেন। সকালে সূর্যের আলো প্রথম যখন খালের পানিতে পড়ে, তখন রংধনুর সৃষ্টি হয়। পর্যটকরা এ দৃশ্য দেখতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন। মনোরোম তিনাপ সাইতার যদিও দুর্গম এলাকায়, তবুও পর্যটকরা নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় জমায় সেখানে। খাড়া পাহাড় থেকে ঝরনার পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
কিভাবে যাবেনঃ
রোয়াংছড়ি যেতে হলে প্রথমে বান্দরবন যেতে হবে। ঢাকা থেকে এসি/নন এসি সব ধরনের বাসই বান্দরবন যায়।ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠতে হবে।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার।। হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)