দাওয়াইপানি ভ্রমণ-

দাওয়াইপানি (Dawaipani) দার্জিলিং এর কাছে অবস্থিত এক ছোট্ট সুন্দর অদ্ভুত গ্রাম দাওয়াইপানি, যেখানের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি বাড়ি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার হাতছানি দেয়। দাওয়াইপানি থেকে দেখতে পাওয়া যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার সুস্পষ্ট রূপ। এছাড়া আরো কয়েকটি শৃঙ্গের অপার্থিব রূপ মন ভালো করে দিবে। নামচির চারধাম এবং সামদ্রুপসে মঠ ও স্পষ্ট দেখা যায় দাওয়াইপানি থেকে।। গ্রামটি থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্যও অসাধারণ। আপনি যদি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, ব্যালকনিতে বসে, চায়ের কাপ হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চান, তাহলে আপনার গন্তব্য হোক পাহাড় চূড়ায় ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম দাওয়াইপানিতে। গ্রামের একপ্রান্ত থেকে দেখা যায় দার্জিলিং শহর। সূর্য ডুবলে আলোকিত দার্জিলিং এর দিকে তাকালে মুগ্ধ হবেনই। যারা পাখি ভালোবাসেন তাদের জন্য আদর্শ জায়গা এই গ্রাম, হিমালয়ের জানা-অজানা বিচিত্র সব পাখি দেখে দিন কাটিয়ে দিতে পারবেন অনায়াসে। ছবি তোলার জন্যও আদর্শ এই জায়গা। পাহাড় চড়ার সুযোগও আছে দাওয়াইপানি গ্রামে। হিমালয়ের কোলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া শান্ত, সুন্দর, নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রামটি পর্যটকদের কাছে অফবিট ঠিকই, কিন্তু যারা প্রকৃতি ভালোবাসে তাদের কাছে এটা স্বর্গরাজ্য।

দার্জিলিংয়ের ঠিক উল্টো দিকের পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা নিরিবিলি এই  দাওয়াইপানি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে পাবেন শ্যাওলা ধরা সুউচ্চ পাইনের ছায়াঘেরা জঙ্গল, ফার্নের ঝোপ, পাহাড়ি অর্কিড, রংবেরঙ্গের পাখি আর মেঘেদের ভেলা; রৌদ্রজ্জ্বল দিনে চোখ তুললে দেখা মিললেও মিলতে পারে রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার, এত কিছুর মাঝে নিজেকেই বেমানান মনে হবে তখন।

দার্জিলিং ম্যাল থেকে পশ্চিমের পাহাড়ে চোখ মেলে দিলে সবুজের সাম্রাজ্যের মাঝখানে মুখ লুকিয়ে দাওয়াইপানি গ্রাম। গাড়ির রাস্তা অনেকটা ঘুরে গেলেও আকাশপথে উড়ে যাওয়া সম্ভব হলে দু’জায়গার দূরত্ব মাত্র ৪ কিমি। এক-দেড় বছর হল পরিচিতির আলো পেয়েছে। দার্জিলিংয়ের ঠিক বিপরীতে দাওয়াইপানি হওয়ায় এ গ্রাম থেকে শৈলশহরের দৃশ্য বিমুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে হয়। প্রায় ৬ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে দিনের বেলায় দার্জিলিংকে দেখলে মনে হবে, গিরিশিরায় অগণিত ফুল ফুটে আছে। খুঁতখুঁতে মন হলে, কংক্রিটের জঙ্গল ভাবতেও পারেন। গিরিশিরা জুড়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের আশ্চর্য সুন্দর অকাল দেওয়ালি। এখানেই শেষ নয়, আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তবে তো দাওয়াইপানি তুলনাহীন। দিগন্তে ঝকঝক করে কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত হিমালয়ের অনেকগুলি বরফচূড়া। ডিসেম্বরের শেষে ঝকঝকে মেঘহীন দিনে ২৪ ঘণ্টাই তুষাররাজ্য দেখা যায়। বস্তুত, দার্জিলিংয়ের আকাশে বরফাবৃত হিমালয়ের এমন বিস্তীর্ণ অংশ দেখা যায় না৷

নেপাল থেকে ভুটান হিমালয়ের সব নামজাদা শৃঙ্গ এক ফ্রেমে। তার নীচের পাহাড়ে সিকিমের জোড়থাং ও নামচি শহর এবং বিস্তীর্ণ পার্বত্য গ্রামাঞ্চল। সূর্যোদয়ের রঙে যেমন অপরূপ লাগে বরফের পাহাড়গুলিকে, তেমনই সূর্যাস্তের কমলা আলো এক অপার্থিব মায়ার পরিবেশ তৈরি করে। সূর্য ডুবলে দার্জিলিং-এর দিকে তাকালে মনে হবে যেন দীপাবলি চলছে। প্রত্যেক রাতে এভাবেই আলোয় সেজে ওঠে গোটা শহর।

দাওয়াইপানির দর্শনীয়স্থান সমূহ

কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়, জঙ্গলের অজানা-অচেনা গাছপালা – সব নিয়ে জায়গাটি অনবদ্য। দাওয়াইপানির আশেপাশে বিখ্যাত কয়েকটি চা বাগিচা রয়েছে – যেমন গ্লেনবার্ন, লামাহাট্টা, তাকদা চা বাগান। যে কোনো একটায় ঘুরে আসতে পারেন সহজেই। বাগান থেকে চা তোলা কিংবা প্রক্রিয়াকরণ দেখতে পাবেন সরাসরি। চেখে নিতে পারেন বাগানের টাটকা চা। দার্জিলিং শহর তো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। সেখানে একদিনের সফরে গিয়ে ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া করে ফিরে আসতে পারবেন। আরও কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম যেমন; সিটং অথবা কালিম্পং অনায়াসেই ঘুরে আসা যায় দিনে দিনে ।

কেন নাম হলদাওয়াইপানি

‘দাওয়াইপানি’ নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এক গল্প। স্থানীয়রা বলেন, গ্রামের ঝোড়ার জলে ওষুধ আছে। জানা যায়, বহু বছর আগে এক ইংরেজ সাহেবকে জঙ্গলের দেখভালের জন্য ইজারাদার বা Forest Ranger হিসবে দার্জিলিং এবং সংলগ্ন এলাক্য পাঠানো হয়েছিল। তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি সারা জায়গায় ঘুরতেন এবং পাহাড়ি ঝোড়ার জল খেতেন। সেই জল তাঁর পায়েও লাগত। এ ভাবেই দিনের পর দিন পায়ে জল লাগতে লাগতে, তাঁর পায়ের ক্ষত সেরে ওঠে। তখন ব্রিটিশরা সেখানকার জল নিয়ে পরীক্ষা শুরু করে। দেখা যায়, সেই জল মিনারেলে ভর্তি। সেই থেকেই ঝোড়া তথা গ্রামের নাম হয় ‘মিনারেল স্প্রিং ভিলেজ’ (Mineral Spring Village)। লেবংয়ের নীচের অংশটি এখনও গুগল ম্যাপে ওই নামে পরিচিত। ‘দাওয়াই-পানি’ নাম হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে নাম হয় দাওয়াইপানি।

ব্যস্ত ঘোরাঘুরি নয়, চুপচাপ নির্জনে প্রকৃতির রূপসুধা পানে মন হলে দাওয়াইপানি চলে যান। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যে রংবাহারি শোভা দেখবেন বরফাবৃত হিমালয়ের বুকে, তা সহজে ভুলতে পারবেন না। সম্প্রতি অনেকগুলি হোম স্টে তৈরি হয়েছে মূল রাস্তার গায়ে। সবগুলি থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। পুরো দাওয়াইপানি গ্রামটাই যেন ভিউপয়েন্ট। দার্জিলিংয়ের মতো রাত থাকতে উঠে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে টাইগার হিলে যাওয়ার কোনও দরকার নেই, এখানে কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিলেই হল। বাকি দিন সকাল থেকে সন্ধ্যে গ্রামের মানুষের সহজ সরল মিশুকে স্বভাব ও তুলনাহীন অতিথিপরায়ণ মনের পরিচয় পেয়ে ভ্রমণ অন্য মাধুর্যে ভরে উঠবে। হিমালয়ের চেনা-অচেনা পাখি দেখায় মন হলে তো সোনায় সোহাগা। কয়েকটি মনোরম নেচার ট্রেল রয়েছে গ্রামের আশেপাশে। নিরাপদ পার্বত্য অরণ্য প্রকৃতি পড়ুয়ার মুক্ত পাঠশালা। হোমস্টে-র সদস্যরাই আধবেলার পদযাত্রায় আপনার গাইড হবেন।

ভ্রমণের সেরা সময়

দাওয়াইপানিতে সারা বছরই ঠান্ডা থাকে। তবে বর্ষার সময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। তখন না যাওয়াই ভালো। বছরের অন্য যে কোনো সময়ে আপনি এই গ্রামে ঘুরে আসতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত গরম জামা নিতে ভুলবেন না।

কিভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে ট্রেনে যেতে চাইলে হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) পৌঁছতে হবে। এনজেপি বা শিলিগুড়ি থেকে দাওয়াইপানির দূরত্ব ৮১ কিমি ও জোরবাংলো থেকে ১৫ কিমি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সময় লাগবে কম বেশি ৩ – সাড়ে ৩ ঘন্টা। খরচ কমাতে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং গামী শেয়ার জিপে জোরবাংলো এসে সেখান থেকে গাড়িতে চলে যাওয়া যায় দাওয়াইপানি। এছাড়া কলকাতা দমদম বিমান বন্দর থেকে বিমানে বাগডোগরা নেমেও দাওয়াইপানি যাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট থেকে ৭৫ কিলোমিটার পেরিয়ে দাওয়াইপানি পৌঁছতে ৩ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।

কোথায় থাকবেন

দাওয়াইপানিতে থাকার জন্য ৮-১০ টা হোমস্টে আছে । ভাড়া থাকা খাওয়া জনপ্রতি ১২৫০ টাকা।

দু’টির ফোন নম্বর দেওয়া হল – 

বীরেনস হোমস্টে  যোগাযোগ এর নম্বর ৯৬৪১৪৫২৭১৮

রোভার্স হোমস্টে  যোগাযোগ এর নম্বর ৯০০৭১৩৮৫০৪

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ