কাশ্মীর ভ্রমণ-
কাশ্মীর (Kashmir) দুনিয়ার বেহেশত, নাম শুনলেই সবুজ প্রকৃতির দিকে মন চলে যায়। হৃদয়ে হিল্লোল তুলে মুগ্ধ করা আবেশের। প্রাণে প্রাণে বাজে প্রেরণার সুর। আহ্, কি সুন্দর করে সাজিয়েছেন এ প্রকৃতি, এ ধরা, এ জায়গা। যেন প্রভুর হাতে গড়া সুন্দর, মনোরম আর নয়নজুড়ানো ভুবন ভুলানো দৃশ্য। সৌন্দর্যের লীলাভূমির ভূস্বর্গ বলা হয় কাশ্মীরকে। প্রধানত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এই কাশ্মীর। ভারতের এই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটির দক্ষিণে ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্য দুটি অবস্থিত। কাশ্মীর মূলত বিশ্বের দর্শনার্থীদের কাছে একটি জনপ্রিয় চোখ জুড়ানো স্থান। যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর লাখ লাখ দর্শনার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ভীড় জমায়।
জম্মু এবং কাশ্মীরের গ্রেটার অংশটি ভারত, পাকিস্তান ও চীন, এই তিনটি দেশে পড়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ ভারতে পড়েছে। হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম অংশটি কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান ছুঁয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত এই এলাকায় কাশ্মীর ভ্যালিতে ৯৫%, জম্মুতে ৩০% এবং লাদাখে ৪৬% মুসলিম বসবাস করে। মোট জনসংখ্যা ৭.২৫ মিলিয়নের একটু বেশি। এখানে বিভিন্ন সময় হিন্দু, বৌদ্ধ, আফগান, শিখ, মীর ও মুঘলদের শাসন ছিল। ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন শাসনের নিদর্শন এখনও দেখা যায়।
ভৌগোলিকভাবে ভারত এমন এক জায়গায় যেখানে আপনি ভ্রমণের সব ধরণের অভিজ্ঞতা পাবেন। পাহাড়, সমুদ্র, সবুজ সমতল ভূমি, নদী, ঝর্ণা, ওয়াইল্ড লাইফ ও এমনকি মরুভূমিও পাবেন। আবহাওয়ার কথা বিবেচনায়ও অধিকাংশ ঋতু ভারত ও বাংলাদেশে আছে।
কাশ্মীর এর দর্শনীয় স্থান
শ্রীনগর শহর
প্রথমেই চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় বরফের মতো সাদা তুষার। শ্রীনগর শহরের ভিতর রয়েছে ডাল লেক,নাগিন লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন,ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন, নিশাত বাগ, শালিমার বাগ, চাশমেশাহী বাগ,পারিমহল,হযরত বাল দরগাহ, শংকরাচার্যহিল। শহরের মধ্যে দেখার জায়গাগুলো একদিনেই ঘুরা সম্ভব।
আরু ভ্যালি
ভূস্বর্গ কাশ্মীর সত্যিই স্বর্গ। ঈশ্বর কাশ্মীরকে তুলি দিয়ে সুন্দর করে একেঁছেন।। আরু ভ্যালি কাশ্মীরের পেহেলগাম থেকে ১২ কি.মি দূরের ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম। লিডার নদী এর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।। এখান থেকে দেখতে পাবেন লিডার নদী উৎস কোলাহাই হিমবাহ।। পেহেলগাম এর তুলনায় আরুতে ঠান্ডা বেশি।। গরমকালে গেলে প্রকৃতির সবুজ৷ রুপ দেখা যায়।। আর শীতের সময় আরু ভ্যালিতে বরফের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য চোখে পড়ে, তখন স্কেটিং এর জন্য প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয় আরু ভ্যালিতে।।
গুরেজ উপত্যকা
শ্রীনগর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গুরেজ ভ্যালি। এই প্রান্তিক এলাকায় এখনও সে ভাবে পর্যটকদের ভিড় হয় না। আপনি যদি নিরিবিলিতে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে চান, তাহলে গুরেজ উপত্যকা অবশ্যই ঘুরে আসুন। কিষাণগঙ্গা নদীর ধারে এখানে ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম আপনাকে মুগ্ধ করবে।
পেহেলগাম
শ্রীনগর থেকে প্রায় ৯৭ কিমি দূরে অবস্থিত। অনন্তনাগ থেকে বাকি অংশটা গেলে শুধু রাস্তার দুপাশে পড়বে আপেলের বাগান। জুলাই থেকে অক্টোবর, এই সময়ের মধ্যে গেলে গাছে আপেল দেখা যায়। পাহেলগাম নেমে আবার ছোট গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে বেড়াতে হয়।
সেভেন লেক ট্রেক
কাশ্মীরে গেলে নিজের ট্রেকিং শ্যু অবশ্যই নিয়ে যাবেন। এখানকার সেভেন লেক ট্রেক মিস করবেন না। সোনমার্গ থেকে শুরু হয় এই ট্রেকিং। পুরো সেভেন লেক ট্রেকিং শেষ করতে আট দিন সময় লাগে। হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন এই ট্রেকিং-এর পথে। এই অভিজ্ঞতা আপনি কোনও দিন ভুলতে পারবেন না।
গুলমার্গ
সারা বছর বরফের জন্য গুলমার্গ বিখ্যাত। যা শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫২ কি.মি দূরে অবস্থিত। যেতে ও ফিরে আসতে সারা দিন লেগে যায়। মানে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় লাগে। শ্রীনগর শহর থেকে গুলমার্গ যেতে গাড়ী ভাড়া নেবে ২০০০ রুপি। ওখানে দুই ধাপের কেবল কার বা রোপওয়ে আছে। নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে গেলে একধাপ উঠলেই বরফ দেখা যায়, যার ভাড়া ৭৫০ রুপি করে। আর বাকি সময়ে গেলে দ্বিতীয় ধাপে উঠলে বরফ মেলে যার ভাড়া আরও ৯০০ রুপি করে।
ট্রাউট ফিশিং
আপনি যদি মাছ ধরতে ভালোবাসেন, কাশ্মীরের লিডার উপত্যকায় ট্রাউট মাছ অবশ্যই ধরবেন। এখানকার স্ফটিকের মতো স্বচ্ছে জলে সেরা ট্রাউট মাছ পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পর্যটক এখানে ট্রাউট মাছ ধরতে আসে।
সোনমার্গ
শ্রীনগর থেকে ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত, দ্রাস, কারগিল, লে লাদাখের পথে। সেখানে পৌঁছাতে পথে পড়বে অপরূপ সিন্ধু নদ। অনেক সুন্দর উপত্যকা ও ঝর্ণা দেখা যায় সেখানে। সোনামার্গে ঘোরার জায়গার মধ্যে জাজিলা পাস, থাজিওয়াস গ্লেসিয়ার,গঙ্গাবাল লেক, গাদসার লেক, ভিসান্তার লেক, সাসতার লেক। কিন্তু এসবের বাইরে দুধপত্রী, কোকরনাগ, ডাকসুম কিংবা সিনথেনটপের সৌন্দর্য আরও মনমুগ্ধকর। আহারবালের জলপ্রপাতটিও অনন্য এক গন্তব্য। বাডগাম জেলার চারার-এ-শরীফে যাওয়ার রাস্তাটিতে না গেলে হিমালয়ের রূপ উপলব্ধি করা অসম্ভব। সেখান থেকে আরো ওপরে গেলে দেখা মেলে দুধগঙ্গার। উত্তরে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্বাদুপানির লেকের নাম উলার লেক। গ্যান্ডারবালে আরেকটি ছোট্ট লেকের নাম মানসবাল।
শিকারায় শপিং
ডাল লেকে হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা কাশ্মীরে গেলে অবশ্যই আপনার হবে। তার সঙ্গে শিকারায় ভেসে শপিং অবশ্যই করবেন। শ্রীনগরের এই ভাসমান বাজার সত্যিই আপনাকে তাক লাগিয়ে দেবে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শিকারায় কেনাকাটা তো করবেনই, তার সঙ্গে ছবি তোলাও মিস করবেন না।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
কাশ্মীরে বেড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এপ্রিল-অক্টোবর। তবে কাশ্মীরের পরিপূর্ণ রূপ উপভোগ করতে হলে, আপনাকে কমপক্ষে তিনবার যেতে হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, যখন বর্ষার শেষে চারিদিকে থাকবে সবুজের সমারোহ, গাছে গাছে ধরবে আপেল। ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি, যখন বরফে ছেয়ে যাবে সব কিছু।
- সারা বছর কাশ্মীর ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু ভালো সময় হলো মার্চ থেকে অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে দুটি বেশি রোমাঞ্চকর সময় হলো –
- টিউলিপ ফেস্টিভাল (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল এর মাঝামাঝি)। এটি আসলে বসন্তকাল। বরফ ও সদ্য সবুজ প্রকৃতির সাথে টিউলিপসহ বেশকিছু ফুল বোনাস।
- আপেলের সময় (জুন-জুলাই)। এ সময়ে প্রকৃতি পুরো সবুজ রঙ ধারণ করে, সাথে ফুল ও ফলের সমারোহ। এই সময়ে ডাল লেকে কাশ্মীরের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুল-ফলের ভাসমান বাজার বসে। ম্যাপেল লিফ লাল হয়ে বিছিয়ে থাকে।
- পেহেলগামে গল্ফ ও রিভার রাফটিং এর মতো অ্যাক্টিভিটির জন্য এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস ভালো সময়। এছাড়া মার্চ মাসের আগে কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করলেও ভালো লাগবে, বিশেষভাবে পেহেলগাম, এই সময়ে ভ্রমণ আনন্দদায়ক।
কাশ্মীর ভ্রমণ খরচ
ট্রেনে কলকাতা থেকে জম্বু পর্যন্ত নন-এসি স্লিপারের ভাড়া ২২০০-২৫০০ আর এসির ৩৩০০-৩৫০০ টাকা। তবে ৬-৮ জন মিলে কাশ্মির গেলে খরচ কম হয়। সেক্ষেত্রে জম্বু থেকে শ্রীনগর যাওয়ার জনপ্রতি ভাড়া ৬০০-৮০০ পড়বে। বিমানের ক্ষেত্রে ভাড়া কলকাতা থেকে শ্রীনগর ১২-২০ হাজার। বাসে গেলে জনপ্রতি খরচ পড়বে ১৮০০-২০০০ টাকা, ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার খরচ। তবে সব মিলিয়ে যদি থাকার এবং যাতায়াত খরচ কমানো যায় তাহলে ৩০-৩২ হাজার টাকায় কাশ্মীর ঘুরে আসতে পারবেন আর শপিং ও করতে পারবেন।
কিভাবে যাবেন কাশ্মীরঃ
বিমানে কাশ্মীর ভ্রমণ
কাশ্মীর যেতে হলে ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে প্রথম যেতে হবে দিল্লি ইন্ধিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। অথবা ঢাকা থেকে কলকাতা। পরে সেখান থেকে ডোমেস্টিক বিমানে জম্মু অথবা শ্রীনগর বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে। কলকাতা থেকে সরাসরি শ্রীনগরে কোনো ফ্লাইট নেই। তাই, দিল্লি হয়ে যেতে হয়। তবে,ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-শ্রীনগর এভাবে ভেঙে ভেঙে গেলে খরচ কম হয় তুলনামূলকভাবে। এছাড়া অন্তত এক মাস আগে টিকেট বরাদ্দ করে রাখতে পারলে কম খরচেই বিমানে ভ্রমণ করা সম্ভব। কলকাতা বা দিল্লি থেকে বাস বা ট্রেনযোগে যাওয়া যায়। কলকাতার ট্রেন ৪১-৪৫ ঘণ্টায় আপনাকে নামিয়ে দিতে পারে জম্মুতে। জম্মু থেকে মাত্র ২৫ মিনিট বিমানে উড়ে যেতে পারেন শ্রীনগর।
স্থল পথে কাশ্মীর ভ্রমণ
ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে পারেন গ্রিনলাইন, সোহাগ কিংবা শ্যামলীর এসি বাসে। এ ছাড়া খরচ কমানোর আরেকটি উপায় আছে। তা হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ বাসে সীমান্ত পর্যন্ত যান। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের লোকাল বাস বা ট্রেনযোগে পৌঁছে যান কলকাতায়। যেমন, যদি হরিদাসপুর (বেনাপোল-পেট্রাপোল) সীমান্ত দিয়ে পার হতে চান তাহলে শুরুতে সাতক্ষীরার বাসে পৌঁছান নাভারন মোড় পর্যন্ত। নাভারন থেকে অটোরিকশায় বেনাপোল পৌঁছাতে খরচ হবে মাত্র ২০ টাকা। সীমান্তে দুই দেশের ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আরেকটি অটোরিকশায় ২০ রুপি নেবে বনগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত। বনগাঁও থেকে কলকাতার ট্রেন পাওয়া যায় প্রায় প্রতি ঘণ্টায়ই। টিকেট হবে ২০-৩০ রুপি।
কোথায় থাকবেন
সাধারণ মানের ব্যাচেলার থাকার জন্য হোটেল ৫০০-৬০০ টাকার মাঝে পাবেন ।। আর ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ট হোটেল ১২০০-১৫০০ রুপির ভিতরে পাবেন । এর চেয়ে দামী দামী হোটেল পাবেন ।। আপনার বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী নিয়ে নিন হোটেল ।।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)