সিকিম ভ্রমণ-
সিকিম (Sikkim) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি প্রদেশ। এর উত্তরে রয়েছে তিব্বত, পূর্ব দিকে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং দক্ষিণ দিকে পশ্চিমবঙ্গ। ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে রাসায়নিক মুক্ত বা অর্গানিক রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৬ সালে। সিকিমে চাষবাসে কীটনাশক ব্যবহার রীতিমত অপরাধ। জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করলে জরিমানা করা হয় এমনকি জেল হতে পারে তিন মাসের জন্য।।
সিকিমের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিন সমস্তটাই বৈচিত্র্যময়। পাহাড় – পর্বত, পাহাড়ি ঝর্ণা, গভীর উপত্যকা ঔষধি গাছের জঙ্গল, ঘন বন, সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যন্য সুন্দর জায়গা সিকিম।।হাজারো ফুলে ভরা সিকিমের গ্যাংটক ও লাচুংয়ের মতো উপশহরের প্রতিটা জায়গা পর্যটকের মুগ্ধ করে।।পূর্ব সিকিমের সাঙ্গু লেক এই শহরের আরেক বিশেষ আকর্ষণ।।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা শিলিগুড়ি থেকে এটি মাত্র ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সিকিম কম জনবসতি সম্পন্ন ও ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। পূর্ব হিমালয় এর একটা অংশ সিকিম প্রদেশের ভেতরে এসে পড়েছে। এই প্রদেশটির ৩৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক। ভারতের সর্বোচ্চ ও পৃথিবীর তৃতীয় পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা এ রাজ্যে অবস্থিত। যেটি এখানকার জীববৈচিত্র্যকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে। সিকিমের রাজধানী হল গ্যাংটক। ছোট বড় পাহাড়-পর্বত, আর তার গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, পাহাড়ি বন, সবুজ প্রকৃতি, মনোরম পরিবেশ আর শীতের তুষার সিকিমকে করে তুলেছে পর্যটকদের কাছে একটি স্বর্গরাজ্য। সিকিমের এই রুপ ঐশ্বর্যের জন্য একে “সুখী স্বদেশ” বলা হয়ে থাকে।
সিকিম এর দর্শনীয় স্থান
সিকিম শহর মানেই অনেকে ভেবে থাকেন গ্যাংটক, নাথুলা, ইয়ুকসোম, নামচি, সাঙ্গু লেক, লাচুং জুলুক পেলিং প্রভৃতি।
গ্যাংটক
গ্যাংটক হলো সিকিমের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। গ্যাংটক ও আশে পাশের অঞ্চল পুরোটাই সুবিশাল ও দৃষ্টি নন্দন পাহাড়ে ঘেরা। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ, এবং বিচিত্র প্রানী কুল সব মিলিয়ে গ্যাংটক হয়ে উঠছে প্রকৃতি প্রেমীদের স্বর্গ রাজ্য। রডোডেন্ড্রেন,অর্কিডের ন্যায় ফুল, সাথে লাল পান্ডা, লাল রঙিন পাখি এগুলো গ্যাংটকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।। গ্যাংটকে পর্যটকদের মন মাতানোর জন্য অনেক হ্রদ, ঝর্না ও পাহাড় রয়েছে।। এদের মধ্যে সোমগো ও মেনমেকো হ্রদ বেশি পরিচিত। দার্জিলিং এ কাঞ্চনজঙ্ঘার যে সৌন্দর্য দেখেন, সেই সৌন্দর্য থেকে গ্যাংটক আপনাকে বঞ্চিত করবেনা।। বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন আপনি পাবেন গ্যাংটকে।।
ইয়ুকসোম
পশ্চিম সিকিমের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝর্ণা, ছোট ছোট লেক ও বৌদ্ধ মন্দির আছে। হাইকিং করার সুযোগ ও রয়েছে।।
ইয়ামথাং
ইয়ামথাং ভ্যালি সাধারণত ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস নামে পরিচিত। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে জুন এর মধ্য সময়ে বিভিন্ন রঙের ফুলে পুরো ভ্যালি ঢেকে থাকে।।
লাচুং
উত্তর সিকিমের তিব্বতয়ান বর্ডারের কাছে অবস্থিত লাচুং গ্রাম নদী দিয়ে বিভক্ত। গ্যাংটক থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রামে যেতে প্রায় ৫ ঘন্টার মতো সময় লাগে।। চারপাশে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশে ও ইয়ামথাং ভ্যালি যাবার পথে তিস্তা নদীর স্বচ্ছ নীল পানি ও দুটি অসাধারণ ঝর্ণা মনকে প্রশান্তি এনে দেয়।। ইয়ামথাং ভ্যালি থেকে দূরের পাহাড়ের বরফের সন্ধান পাওয়া যায়।।
নাথাং
পূর্ব সিকিমে এর ছোট্ট একটা গ্রাম নাথাং যা ১৩৫০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত।। জুলুক থেকে লুংফুং হয়ে লক্ষীচকে কুলুপ যাওয়ার রাস্তার বাঁদিকে গেলে নাথাং ভ্যালি। একটি কথা প্রচলিত আছে তুমি যদি নাথাং ভ্যালি পছন্দ না করো তাহলে তুমি স্বর্গও পছন্দ করবেনা। নাথাং ভ্যালিতে সর্ব সাকুল্যে ৫০-৬০ টা বাড়ি, বাড়িগুলোর টিনের চালে ঝুরো ঝুরো বরফকুচি। নাথাং এর কাছেই চায়না বর্ডার, তাই প্রায় সবগুলো বাড়িতেই চাইনিজ মিনি মার্কেট সাজানো।
নামচি
নামচি হল দক্ষিণ সিকিমের সদর শহর, ছোট্ট একটি জনপদ যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৪০০ ফুট (১৩১৫ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত। নামচি থেকে যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়, তেমনই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকার এক সুন্দর দৃশ্য। নামচি ও তার আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে অন্তত একটা গোটা দিন সময় লাগবে।ছোট্ট শহরের বাইরে মূলত রয়েছে দর্শনীয় স্থানগুলি। যেমন নামচি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে টেমি চা বাগান। শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সামদ্রুপচে। এখানে ১৩৫ ফুট উঁচু গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তিটি সত্যিই দেখার মতো। নামচির প্রধান আকর্ষণ শহর থেকে ১০ কিমি দূরে সোলোফোকে ১০৮ ফুট উচ্চ শিব মূর্তি সহ রেপ্লিকারুপি চারধাম। পাহাড়ের মাথায় বিশাল চত্বর জুড়ে বদ্রিনাথ ধাম, জগন্নাথ ধাম, দ্বারকা ও রামেশ্বরম ধাম। রকমারি ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা মনোরম জায়গা।
নামচি শহরের থেকে ৫কিমি দুরে রয়েছে চারধাম কমপ্লেক্স। ভারতের যত বড় বড় মন্দির রয়েছে, সিকিম সরকার তার সবার একটি করে রেপ্লিকা এই কমপ্লেক্সে বানিয়েছে। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, দ্বারকা, জগন্নাথ ধাম, রামেশ্বরধাম এবং আরও অনেক। কিন্তু এখানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো ৮৭ফুট ঊঁচু মহাদেবের প্রতিমা। পার্কের সব জায়গা থেকেই বাবাকে দেখা যায়।
নামচি এর দর্শনীয় স্থানগুলো:
রাবাংলা বুদ্ধ পার্ক, বোরং মনাসট্রি, টেমি টি গার্ডেন, সামদরুপস, চারধাম।
পেলিং শহর
পশ্চিম সিকিমের একটি ছোট শহর পেলিং স্কাই ওয়াক পেলিং এ পাহাড়ের উপর ঝুলন্ত ৫০ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ব্রিজ দিয়ে মন্দিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কোন এডবেঞ্চারের চেয়ে কম নয়।। রিম্বি নদীর পাশের রিম্বি অরেঞ্জ গার্ডেনে এলাচ, কমলা, কাঠ বাদাম ও কমলার গাছ দেখতে পারেন, জনপ্রতি এন্ট্রি ফি ১০ রুপি। কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে অনেকেই এখানে আসেন।।
সাঙ্গু লেক
গ্যাংটক থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সিকিমে অবস্থিত সাঙ্গু লেক।। এই লেকের প্রকৃত সৌন্দর্য লিখে বর্ননা করা সম্ভব না, শুধু অনুভব করা যায়।। বিশেষ করে গ্যাংটক থেকে সাঙ্গু লেকে যাওয়ার রাস্তা অদ্ভুত সুন্দর।। এখানের আবহাওয়া প্রচন্ড ঠান্ডা, যত উপরের দিকে যাওয়া যায় ঠান্ডা তত বাড়তে থাকে। স্নোফলের মাঝে বরফ দিয়ে খেলা করার মজা এখানে না আসলে বুঝা যাবেনা।।
সিকিমের আরও কিছু দর্শনীয় স্থানসমুহঃ
সিকিম প্রদেশটা পুরোটাই একটি পর্যটন এলাকা। এখানে অনেকগুলো টুরিস্ট পয়েন্ট আছে যার সবগুলোই দৃষ্টিনন্দন। তার ভেতরে কয়েকটি হল-
-গুরুদংমার লেক
-বুদ্ধ পার্ক
-নথুলা পাস
-জিরো পয়েন্ট
-জুমথান ভ্যালি
-সিদ্ধেশ্বর ধাম
-রামটেক মঠ
-এম জি মার্গ
-হনুমান টক
-রাঙ্কা মঠ
-ছপ্তা ভেলি
-কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক
-সাই মন্দির
-জুলুক ওয়াইল্ডলাইফ এরিয়া
-সেভেন সিস্টার ওয়াটারফল
-কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়াটার ফল
-বাবা হরভজন সিং মেমোরিয়াল
-যগনোশালা আলপাইন অভয়ারণ্য এবং জলপ্রপাত
-রবন্তস রুইনস
-গনেশ টক
-নর্বুগাঙ্গ পার্ক
-সিঙ্গশোর সেতুসহ আরো অনেক স্থান। এখানকার প্রকৃতির রূপবৈচিত্রে নিঃসন্দেহে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে।
সিকিমে ভ্রমন এর সেরা সময়
যদিও সারা বছরই সিকিমে পর্যটকদের ভিড় জমে ও সবসময়ই এটি ভ্রমণ উপযোগী থাকে। তারপরেও কিছু কিছু সময় সিকিম ভ্রমনের জন্য খুবই উপযোগী। যেমন- গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন মাসে সিকিম এর আবহাওয়া খুবই মনোরম ও সহনশীল থাকে, যার জন্য এসময় এটাকে সিকিম ভ্রমনের বেস্ট সময় বলা হয়ে থাকে।
আবার, শীতকালে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের ভেতরে পুরো সিকিম রাজ্যটি বরফে আবৃত থাকে। তাছাড়া এই সময়টাতে সিকিমে পর্যটকরাও খুব কম আসে, যার জন্য আপনি খুব সহজে এবং খুব কম খরচে হোটেলে রুম বুকিং দিতে পারবেন। জুলাই থেকে মার্চ মাসের ভেতরে সিকিমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং মাঝে মাঝে ভূমিধসের মতো ঘটনা চোখে পড়ে। তাই এ সময় সিকিম ভ্রমণ না করাটাই ভালো।
সিকিম ভ্রমণ খরচ
সিকিমে খাওয়া দাওয়া,যাতায়াত, ঘুরাঘুরি বাবদ ৬ দিন ৭ রাত থাকতে জনপ্রতি ১৬০০০-২০০০০ টাকার মতো লাগবে। তবে সিকিমে ৬/৭ জন এর গ্রুপ করে যাতায়াত করলে ও হোটেল রুম শেয়ার করলে খরচ অনেক কম হবে।।
কোথায় থাকবেন
সিকিম যেহেতু একটি পর্যটন এলাকা, তাই এখানে অসংখ্য হোটেল আছে। যেখানে আপনি চাইলে আপনার থাকার বন্দোবস্তো করতে পারেন। আপনার বাজেটের উপর ভিত্তি করে আপনি বিভিন্ন হোটেলে বিভিন্ন ফ্যাসিলিটির রুম পেয়ে যাবেন। মুল কথা হল আপনি যেমন রুম চান তেমন খরচ করতে হবে।
সিকিমের কিছু জনপ্রিয় হোটেল এবং রিসোর্ট এর নাম দেওয়া হলো। যেগুলোতে আপনি সর্বোচ্চ পরিমাণ সুবিধা পাবেন এবং সাধারণত বেশিরভাগ পর্যটকরাই ভ্রমণের জন্য এই জায়গা গুলো বেছে নেয়। চুম্বি মাউন্টেন রিসোর্ট ও স্পা, মেফায়ার স্পা রিসোর্ট এবং ক্যাসিনো, Welcomheritage Denzong, রিজেন্সি, টেরেস ভ্যালি হোটেল, শারমসার রিসোর্ট, ইরাল রিসোর্ট, এলগিন মাউন্ট, পণ্ডিম রিসোর্ট।
কোথায় কি খাবেন
সিকিমকে বলা হয় “land of organic” এখানে সব জিনিস খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ফ্রেশ, তাই সিকিমে বেড়াতে আসলে ভালো ও ফ্রেশ খাবার খেতে পারবেন।গ্যাংটকের এম জি মার্কেট, লাল বাজার রোডে সস্তার মধ্যে মজার স্ট্রিট ফুড খেতে পারবেন।
কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি সিকিম এ যাওয়ার জন্য আপনি কোনো বাস ট্রেন অথবা বিমান পাবেন না। সিকিমে পৌঁছানোর জন্য আপনার কয়েকটি স্টপে থামতে হতে পারে। বাস অথবা ট্রেনে প্রথমে আপনাকে বেনাপোল যেতে হবে। কিছু কিছু বাস যেমন গ্রীন লাইন, সৌহার্দ্য, শ্যামলী ইত্যাদি সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত সার্ভিস দেয়। আপনি চাইলে এগুলোতেও যেতে পারেন। তো যাই হোক বেনাপোল নামার পর আপনাকে বর্ডার পার হতে হবে। বর্ডার পার হওয়ার পর কলকাতা চলে যাবেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে ১১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন এবং সেখান থেকে জিপ গাড়িতে তিন হাজার টাকার মতো খরচ করলে আপনি সিকিম পৌঁছে যাবেন। সরাসরি সিকিমে বাংলাদেশ থেকে কোন বিমান সার্ভিস চালু নেই। তাই এক্ষেত্রেও আপনাকে মাঝে একটি স্টপে থামতে হবে। প্রথমে আপনাকে ঢাকা থেকে কোলকাতা যেতে হবে এবং কোলকাতা থেকে সিকিম এর নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট পায়কইয়ং এ নামতে হবে।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)