সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ-
সাজেক উপত্যকা (Sajek Valley) মেঘময় এক পৃথিবী, তুলার মতো মেঘমালা, চারদিকে সারি সারি সবুজ পাহাড়। সবুজের রাজ্যে এ যেন সাদা মেঘের হ্রদ!এখানে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। কখনও তীব্র শীত কখনো মুহূর্তের মধ্যেই গরমের অনূভূতি বা বর্ষার মেঘময় আবহাওয়া। চোখের পলকেই হয়তো বা আপনার চারপাশ ঢেকে যাবে সাদাকালো মেঘে। এ যেন মেঘের উপত্যকা। নিজেকে মনে হবে মেঘের রাজ্যের বাসিন্দা। হয়তো মনের অজান্তেই খুঁজতে থাকবেন সাদা মেঘের পরী অথবা মেঘের মধ্যে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসা রাজ পুত্রকে!
অবস্থান
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় স্থান সাজেক ভ্যালি। এমনিতে বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ একটু বেশি। আর সে আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে ‘সাজেক’ উপত্যকা। আয়তনের দিক দিয়ে দেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন পাহাড়িয়া ‘সাজেক’। সাজেক ভ্যালি রাঙামাটির একটি অংশ। দেশের সর্ব বৃহৎ বাঘাইছড়ি উপজেলার ইউনিয়ন সাজেক। আয়তন ৬০৭ বর্গ মাইল। যা দেশের যে কোন জেলার চেয়েও বড়। সম্প্রতি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে সাজেক ভালি।বর্তমানে চাইলে যেকেউ নিজস্ব পরিবহনে অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে বাঘাইছড়ি হয়ে ভারত সীমান্তবর্তী অন্যতম সৌন্দর্য্যমন্ডিত এই উপত্যকায় যেতে পারেন।
সাজেক ভ্যালির বর্ননা
এখানে আঁকা-বাকাঁ উচুঁ নিচু পাহাড়ি পথ ও আকাশের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখার পাশাপাশি অতি নিকটতম সীমান্ত ভারতীয় অংশের পাহাড়ি দৃশ্য উপভোগ করার মতো। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখা যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দূরের সাজেকের পুরোটাই পাহাড়ে মোড়ানো পথ। প্রকৃতির এই রুপ যেন রাঙামাটির ছাদ!নয়নাভিরাম অরণ্যভূমি আর পাহাড়ের বন্ধনেযেখানে মেঘের দল প্রেমে মেতে থাকে। সবুজ পাহাড় ঘিরে ঢেউ খেলানো অসংখ্য উঁচু-নিচু পাহাড়, নয়নাভিরাম নানান দৃশ্য। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে কাচালং ও মাচালং নদী, রাস্তার দু’ধারে-চোখে পড়বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের বৈচিত্রময় জীবন ধারা। সাজেকের সুউচ্চ পাহাড়ে গা ছুঁয়ে ছুটে চলেছে টুকরো টুকরো মেঘ। ভোর বেলা দেখা মিলে কুয়াশার হাতছানি। আর পড়ন্ত বিকালে গোধুলির আলো।।
কংলাক পাহাড়
সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পাবেন মিজোরাম সীমান্তের পাহাড় আর সবুজের মিতালি। কংলাকের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে সত্যি সত্যি ভুলে যাবেন, আপনি ছিলেন কোনো যান্ত্রিক নগরে দূষিত বাতাস, শব্দ এবং কর্কট সমাজে জন্ম নেওয়া মানুষ। আপনার মন, প্রাণ, দেহ পুলকিত হবে এক বিশুদ্ধ চিন্তা এবং অনুভূতিতে। সূর্যোদয় ও অস্ত দেখার সুখানুভূতি সারাজীবন মনে রাখবেন। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে অকবিও হয়ে ওঠেন কবি, অপ্রেমিকও হয়ে ওঠেন প্রেমিক, একজন সচেতনও অবচেতনে হয়ে ওঠেন উন্মাতাল। একজন বৃদ্ধও সবুজের সুরা পান করে হয়ে ওঠেন তেজোদীপ্ত তরুণ।রাতের কংলাক পাহাড়ঃসাজেকের কংলাক পাড়া আশপাশের পাড়াগুলো থেকে সবচেয়ে উপরে বিধায় বাতাসের ঝাপটা ক্রমশ বেশি থাকে ।নক্ষত্র আর মিল্কিওয়েতে ভরা কংলাক, সাজেকের আকাশ। থোকায় থোকায় আকাশে জ্বলছে তারার দল। অত্যন্ত নির্জনতা পাহাড় চূড়োর পাড়া কংলাক। মৌসুমী হাওয়ায় থেমে থেমে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়োয়। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চেনা রাতকেও অচেনা মনে হয়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করে। গাবতলী, কলাবাগানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে পরিবহনগুলোর কাউন্টার। ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে চট্টগ্রাম রোড হয়ে কুমিল্লা, ফেনী পার হয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই হয়ে খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছায়। এতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টার মতো।খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে হবে খোলা জিপে, যা চান্দের গাড়ি নামেই পরিচিত। দুদিনের জন্য ভাড়া করলে আপনাকে গুনতে হবে ৬ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা। চান্দের গাড়িতে আসন সংখ্যা ১২টি।
যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেন
• সঠিক সময়ে এসকোর্ট দেওয়া।
• সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ছবি তোলা যাবে ন
• স্থানীয় লোকজনের ছবি তোলার আগে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে নেবেন।
• ছুটির দিনে কটেজ পাওয়ার ঝামেলা এড়াতে বেশ কয়েক দিন আগে (এক মাস) বুকিং দিন।
• রবি, এয়ারটেল বা টেলিটক সিম সঙ্গে নিন।
• সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখুন।
• সঙ্গে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যান।
• জিপের ছাদে বা মোটরসাইকেলে সতর্ক থাকুন।
কোথায় খাবেন
সাজেকে খাওয়ার জন্য বেশকিছু ভালো মানের রেষ্টুরেন্ট আছে। এসব রেষ্টুরেন্ট এর মধ্যে -ফুডানকি,চিম্বাল,মারুতি দিদির রেষ্টুরেন্ট, কাশবন রেষ্টুরেন্ট ,মনটানার রেষ্টুরেন্ট ভালো। এদের খাবার ভালো প্রতি বেলা ২০০ টাকায় ডাল,ভাত,সবজি দেশি মুরগীর প্যাকেজ পাওয়া যায়।।
সাজেক ভ্যালির বিভিন্ন রিসোর্টের ভাড়া, যোগাযোগ, বুকিং তথ্য এবং খরচ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য-
সাজেক খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নিকটবর্তী হওয়ায় এখানের পর্যটন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট বা গেস্ট হাউজই আপনার জন্য ভালো হবে। সাজেক পাহাড়ের উঁচুতেও অনেক রিসোর্ট রয়েছে।।
সাজেক রিসোর্ট
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত রিসোর্ট সাজেক রিসোর্ট। যার দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ আছে। খাবারের ব্যবস্থা আছে। এসি আর নন এসি রুম গুলোর ভাড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেনাবাহিনিতে কর্মরত বা প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যে বিশেষ ছাড় রয়েছে। যোগাযোগ: ০১৮৫৯০২৫৬৯৪ অথবা ০১৮৪৭০৭০৩৯৫।
রুন্ময় রিসোর্ট
এই রিসোর্টে মোট পাঁচটি রুম রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে ২ জন থাকতে পারবেন। নিচ তলার রুম ভাড়া ৪ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি কক্ষে ২ জনের বেশি থাকতে চাইলে ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নিতে পারবেন। উপরের তলায় দুজন করে থাকার দুইটি কক্ষ রয়েছে, ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৬৫৪৭৬৮৮।
মেঘ মাচাং
মেঘ মাচাং রিসোর্ট অনেকের পছন্দের শীর্ষে। কারণ, সুন্দর ভিউ ও তুলনামূলক কম খরচে থাকা যায় এখানে। আছে খাবারের ব্যবস্থা। মেঘ মাচাং-এ পাঁচটি কটেজ আছে। ভাড়া ৩ হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৮২২১৬৮৮৭৭।
লুসাই কটেজ
কাপল রুম, ডাবল বেডসহ আছে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। সুন্দর ডেকোরেশন ও ভালো ল্যান্ডস্কেপিক ভিউয়ের এই কটেজের রুমের ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৬৩৪১৯৮০০৫।
মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট
সুন্দর ইকো সাজসজ্জা ও আকর্ষণীয় ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ সহ মেঘপুঞ্জিতে আছে ৪টি কটেজ, প্রতিটিতে ৩-৪ জন থাকা যাবে। ভাড়া চার হাজার টাকা। যোগাযোগ: ০১৮১৫৭৬১০৬৫।
ম্যাডভেঞ্চার রিসোর্ট
রিসোর্টটির ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ অসাধারণ। কাপল রুম সিঙ্গেল বেড ২ হাজার টাকা, ডাবল বেড- ২ হাজার ৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৮৫৪২৪২৪২।
আলো রিসোর্ট
সাজেকের একটু আগে রুইলুই পাড়াতে অবস্থিত। এখানে ৬টি রুম রয়েছে। ৪টি ডাবল ২টি সিঙ্গেল। বুকিং দিতে যোগাযোগ করুন পলাশ চাকমা, মোবাইল-০১৮৬৩-৬০৬৯০৬, ০৩৭১-৬২০৬৭।
ইমানুয়েল রিসোর্ট
এই রিসোর্টটি মেয়ে বা পরিবারের জন্য আদর্শ নয়। তবে ছেলেরা তাদের বন্ধুদের নিয়ে থাকতে পারবেন। এখানে মোট ৮টি রুম রয়েছে। তবে সবগুলোই কমন বাথরুম। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করুন মইয়া লুসাই, মোবাইল- ০১৮৬৫-৩৪৯১৩০, ০১৮৬৯-৪৯০৮৬৮।
আদিবাসী ঘর
কম খরচে থাকতে চাইলে আদিবাসিদের ঘরেও থাকতে পারবেন। জনপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় থাকা যাবে। ফ্যামিলি বা কাপল থাকার জন্যে আদর্শ না হলেও বন্ধু বান্ধব মিলে একসঙ্গে থাকা যাবে।কম খরচে জুমঘরে থাকা যাবে। যোগাযোগ-০১৮৮৪-২০৮০৬০ নাম্বারে।
উপরে রিসোর্ট এবং কটেজগুলো নিয়মিত ভাড়ার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। শুক্র-শনিবার এবং বিভিন্ন বিশেষ ছুটির দিনে ভাড়ার পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। আবার অনেক সময় পর্যটকের আনাগোনা কম থাকলে রিসোর্টগুলোতে কিছুটা ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়।
ঘুরবেন যেভাবে
সাজেক ভ্যালি পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া করার পর দীর্ঘ যাত্রার শেষে আপনাকে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে। এ ছাড়া সাজেকের কাঠফাঁটা দুপুরের রোদে না ঘোরাঘুরি করে রোদ পড়ার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। বিকেলে জিপে করে আপনি ঘুরে আসতে পারেন সাজেক ভ্যালির আরও ভেতরে। সেখানে একটু উঁচু টিলায় উঠলেই উপভোগ করতে পারবেন সূর্যাস্ত। সাজেকের সন্ধ্যা নামে অপরূপ এক সৌন্দর্য নিয়ে। দেখবেন মেঘমুক্ত নীলাকাশ একটু একটু করে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আর মিটিমিটি করে জ্বলে উঠছে একটি দুটি করে তারা। দেখবেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে একটি-দুটি থেকে সহস্র তারা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠবে। হয়তো আপনি এরকম তারাভরা আকাশ জীবনেও দেখেননি।সন্ধ্যার তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিলে আপনার হৃদয়ে যে অনুভূতি আসবে, সেটাই হতে পারে আপনার সাজেক ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আনন্দ। যারা আকাশ ভরা তারা দেখতে ভালোবাসেন; তাদের জন্য সাজেক খুবই আদর্শ একটি জায়গা।সুতারাং মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি দেখতে ঘুরে আসুন দেশের অন্যতম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সাজেক ভ্যালি থেকে।। চারপাশে মনোরম পাহাড় সারি,সাদা তুলোর মতো মেঘের ভ্যালি আপনাকে মুগ্ধ করবেই।। সাজেক এমন আশ্চর্য জায়গা যেখানে দিনে কয়েকবার প্রকৃতির বদল দেখা যায়.. ভিন্ন রকম রূপের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। কখনো গরম অনূভূত হবে তারপর হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন কিংবা চোখের পলকে মেঘের ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাবে আপনার চারপাশ।প্রাকৃতিক নিসর্গ আর তুলোর মতো মেঘের পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়াউড়ির খেলা দেখতে সাজেক আদর্শ জায়গা।।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং।
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)