শিলং ভ্রমণ–
শিলং (Shillong) উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। মেঘের বাসা বলেও ডাকা হয় শিলংকে। এটি মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। শিলং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং ভুটান-ভারত সীমান্তের প্রায় ১০০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। মেঘালয় ও পূর্ব খাসি পার্বত্য জেলার রাজধানী এই শিলং, যাকে বলা হয় হিল স্টেশন।
পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত শিলংয়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৬ ফুট। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এখানে রয়েছে পাইন অরণ্য, জলপ্রপাত এবং পার্বত্য জলধারার সমারোহ। পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, আর পাহাড়ি লেক মিলে শিলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এছাড়া খাসিয়া ও স্থানীয়দের জীবন-যাপন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শিলংকে দিয়েছে বাড়তি রূপ। শিলংকে এক সময় ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ বলা হতো। সে কারণে এক সময় বিলেত থেকে প্রচুর পর্যটক শিলংয়ে অবকাশ যাপন করতে আসতেন।
শিলং এর দর্শনীয় স্থান
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং ভিলেজ ছাড়াও শিলংয়ে রয়েছে উমিয়াম লেক, এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত, শিলং পার্ক বা শিলং ভিউপয়েন্ট, গল্ফ লিঙ্ক, ওয়ার্ড’স লেক, লাইটলুম ক্যানিয়ন, অল সেন্টস চার্চ, চেরাপুঞ্জি এবং কেনাকাটার জন্য প্রসিদ্ধ পুলিশ বাজার।
শিলং পিক
খাসি পাহাড়ের সৌন্দর্য আর পুরো শিলং শহরকে পাখির দৃষ্টিতে দেখতে হলে উঠতে হবে মেঘালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৬ হাজার ফুট উঁচুতে এই চূড়াকেই বলে শিলং পিক।
উমিয়াম লেক
স্কটল্যান্ডের সমুদ্র শাখা বা হ্রদের সাথে তুলনাময়, উমিয়াম লেক শিলং থেকে বেশ কিছু দূরত্বে অবস্থিত। কেউ যদি শুধুমাত্র পর্যটকদের থেকে নির্বিঘ্নে একটি ছবির মতো নিখুঁত প্রশান্ত হ্রদের ধারে বসে থাকতে ভালবাসেন, উমিয়াম লেক সেইরকম একটি স্থান হতে পারে। । মূলত এখানকার দেয়া একটি বাঁধ থেকে এই হ্রদের সৃষ্টি। শিলংয়ের পানির মূল উৎস হলো এই উমিয়াম হ্রদ। আপনি যদি শীতকালে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারিতে উমিয়াম হ্রদ দেখার পরিকল্পনা করেন তবে হ্রদের সৌন্দর্য দেখে বোকাও হয়েও যেতে পারেন।
এই সময়টায় হ্রদের সৌন্দর্য থাকে তুঙ্গে, কানায় কানায় থাকে ভরপুর পানি দিয়ে। আর গরমের সময় মে থেকে জুলাইতে যদি আবার এই হ্রদ দেখতে আসেন তবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে এটাই সেই হ্রদ যা আপনি শীতকালে দেখে গিয়েছিলেন, পানি শুকিয়ে তখন নিচের চরের দেখা মেলে পরিপূর্ণভাবে। সেটিও একরকমের সৌন্দর্য। এমনিতে হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার বিভিন্ন ব্যবস্থা করে রাখা আছে সেখানে, তবে সবকিছুর খুব বেশি দাম। তবে সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ পেতে চাইলে নৌকা ভ্রমণ করতে পারেন এই হ্রদে।
মাওলিনং গ্রাম
শিলং মেঘালয়ের আকর্ষণ আর শিলং এর আকর্ষণ মাওলিনং গ্রাম। শিলং মূল শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, পরপর কয়েকবার এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এই গ্রামের একটি রাস্তাতেও আপনি খুঁজে পাবেন না ময়লা বা আবর্জনা জাতীয় কিছু। মাওলিনং গ্রাম নিজেই একটা ঘুরতে যাওয়ার স্থান।
দ্য এলিফেন্ট ফলস
শিলং মেঘালয়ের জাদুর শহর। প্রচুর ভ্রমণ আকর্ষণের মধ্যে এখানে লুকিয়ে আছে এলিফ্যান্ট ফলসের মতো আরো অনেক আকর্ষণ। শিলং ঘুরতে গেলে মানুষ যে জায়গাটায় প্রচুর যায় তা হলো এলিফ্যান্ট ফলস বা ঐরাবত জলপ্রপাত। এরূপ নামকরণে পেছনে কারণও আছে যথেষ্ট। এই জলপ্রপাতের কালো পাথরগুলো মিলিত হয়ে এক ঐরাবত আকৃতির সৃষ্টি করেছিল, সেই থেকে এর নাম দ্য এলিফ্যান্ট ফলস।
গল্ফ লিঙ্ক
এটি ভারতের প্রথম ১৮ টি গহ্বর যুক্ত গল্ফ ক্ষেত্র। আজকের দিনে, এটি শিলং-এর দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ এবং এই জলপ্রপাতটি অনেক স্থানীয়দের দৈনন্দিন যাতায়াতের পথেই পড়ে। গল্ফ ক্ষেত্রটির, এখানে সেখানে পাইন বৃক্ষ বেড়ে উঠেছে, দেখে মনে হয় যেন এক বিশাল সবুজ গালিচার আলতো ঢালু ঢিবের উপর ঘূর্ণমান রয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের গল্ফ ক্ষেত্রগুলি প্রথম পরিদর্শিত পর্যটকদের ভীষণ আকর্ষণ করে।
ওয়ার্ড’স লেক
গল্ফ ক্ষেত্র থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বের মধ্যেই শোভামন্ডিত সেতু, নৌকাচালনার সুবিধা ও রাজহাঁসেদের সঙ্গে সৌন্দর্যবর্ধিত এই সুন্দর হ্রদটি আচ্ছাদিত রয়েছে।
লৈৎলাম গিরিখাত
লৈৎলামের সুন্দর গিরিখাতটি এক চুড়ান্ত আবশ্যক পরিদর্শনযোগ্য স্থান। গিরিখাতটি, প্রধান শহর থেকে গাড়ির মাধ্যমে গেলে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। এটি রাসোং গ্রামের নীচের এক অত্যাশ্চর্য্য দৃশ্য উপলব্ধ করায়। লৈৎলাম গিরিখাতের চূড়া পিকনিকের জন্য মহান জায়গা। দুরুহ-মজ্জার ট্রেকার বা পদ ভ্রমণ কারীরা, গ্রামের নীচে ট্রেক করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
অল সেন্টস চার্চ
বর্তমানে অল সেন্টস ক্যাথিড্রাল নামে অভিহিত, এই ভবনটি একশ বছরের চেয়েও পুরনো। স্থানীয় খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের জমায়েতই শুধুমাত্র তাদের দৈনন্দিন প্রার্থনার জন্য এই গির্জায় ভিড় করে না, বরঞ্চ পরিদর্শন করতে আসা পর্যটকরাও তার ইতিহাস ও স্থাপত্যের সাক্ষী হতে এখানে ভিড় করে।
লেডি হাইদরি উদ্যান
এই জাপানি শৈলীর উদ্যানটি, ছোট ছোট পুকুরের এক উদার সিঞ্চনে, প্রেমীদের স্বর্গোদ্যান হিসাবে গড়ে তুলেছে। এই উদ্যানটিতে একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে এবং বছরের যেকোনও সময় প্রচুর উৎসাহী শিশুরা খাঁচার মধ্যে থাকা আলস্যময় ভালুকদেরকে একদৃষ্টে দৃষ্টিপাত করে আছে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও উদ্যানটিতে একটি মিউজিয়াম ও যাদুঘর রয়েছে; যেখানে আপনি পাইথন (ময়াল সাপের) চর্ম, চিতা, হাতির মস্তকের খুলি ও বিরল জীবজন্তুর ছবি দেখতে পেতে পারেন।
চেরাপুঞ্জি
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪৮৬৯ ফুট। এটি পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার অংশ। চেরাপুঞ্জির আগের নাম ছিলো ‘সোহরা’। স্থানীয় ভাষায় সোহরা অর্থ চূড়া। কারণ এলাকাটির অবস্থান পাহাড়ের চূড়ায়। পরে নাম রাখা হয় চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি অর্থ কমলালেবুর দ্বীপ। কারণ এখানে কমলালেবুর চাষ বেশি হয়। কমলা ছাড়া এখানে পান-সুপারিও চাষ হয়। অবশ্য চেরাপুঞ্জি বেশি পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চল হিসেবে। চেরাপুঞ্জি একসময় মেঘালয়ের রাজধানী ছিল। ১৮৬৪ সালে চেরাপুঞ্জি থেকে শিলংয়ে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়।
সোনাংপেডেং
সোনাংপেডেং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা হিলস জেলার অন্তর্গত একটি পাহাড়ি অপরুপ গ্রাম। গ্রামটি বাংলাদেশের তামাবিল বর্ডার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার এবং মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সোনাংপেডেং এর সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষন এই গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ, সবুজ জলের পাথুরে নদী “উমংগট”। এই নদীটিই জাফলং সীমান্ত দিয়ে গোয়াইন নদী নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য এই নদীর বাংলাদেশে প্রবেশ মুখেই সিলেটের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র জাফলং অবস্থিত। সোনাংপেডেং যেতে হলে ভিসায় পোর্ট “বাই রোড ডাউকি” থাকতে হবে। তো চলুন ঘুরে আসি স্বচ্ছ জলের গ্রাম “সোনাংপেডেং”।
পুলিশ বাজার
কেনাকাটার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো শিলং এর পুলিশ বাজার। কেনাকাটা করতে হলে তাই পুলিশ বাজারের বিকল্প। কেনাকাটার এই কেন্দ্রটি শিলং-এর বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানকার বেশ কিছু দোকান প্রতীকি মর্যাদা অর্জন করেছে; যেমন – দিল্লী মিষ্টান্ন ভান্ডার, যেখানে জিলিপি বিক্রি হয়। বিক্রেতারা এখানকার ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ডাম্পলিং, সেদ্ধ ডিম, ঠোঙ্গায় মোড়া ভূট্টা ইত্যাদি বিক্রি করেন। শিলং-এর শীতল আবহাওয়ায় এই সমগ্র স্ন্যাকসগুলি আরোও মজাদার বলে মনে হয়।
শিলং ভ্রমনের সেরা সময়
বর্ষাকাল শিলং ভ্রমনের আদর্শ সময়। বর্ষাকালে শিলংয়ের পাহাড় গুলো সবুজে ভরে থাকে এবং ঝর্ণাগুলো পূর্ণতা পায়।তাই জুন-সেপ্টেম্বর শিলং ভ্রমনে যেতে পারেন।
কিভাবে যাবেন
সড়ক পথে মেঘালয় ভ্রমণ করলে খরচ কম হয়।। এক্ষেত্রে শ্যামলী পরিবহন ভিসা ব্যবস্থা সহ সরাসরি ঢাকা থেকে শিলং যাবার ও আসবার সেবা দিয়ে থাকে।। আরও কম টাকায় বা নিজের মতো করে যারা ভ্রমন করতে চান তারা বাসে, প্লেনে বা ট্রেনে করে সিলেট পৌঁছে সেখান থেকে বাসে বা সিনজি করে তামাবিল যাবেন।সেখানে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ডাউকি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বা লোকাল গাড়ি করে সরাসরি শিলং যেতে পারেন।।
কোথায় থাকবেন
শিলং শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। পুলিশ বাজার নামক জায়গাটায় বিশেষ ধরনের অসংখ্য হোটেল দেখা যায়।। ৯০০-১২০০ রুপির মধ্যে বাজেট হোটেল পাওয়া যায়। ইচ্ছে হলে রুম শেয়ার ও করা যায়। ১৫০০-৪৫০০ এর মধ্যে হোটেল ইয়ালানা,বুলভার্ড এবং দিইসি হোটেলে রুম পাওয়া যাবে।।
কোথায় খাবেন
শিলং এর রেস্তোরা গুলোতে শূকর এবং মুরগীর মাংস বেশি পাওয়া যায়..এছাড়া পুলিশ বাজার জামে মসজিদের পাশে মুসলিম রেস্তোরা সাভেরাতে হালাল গরুর মাংস পাওয়া যায়।।শেফস মাল্টি কুজিন এর খাবার বাজেটের মধ্যে মোটামুটি ভালো। শিলং শহরে ফাস্ট ফুড চেইন শপ, কেএফসি ডমিনস, সাবওয়ে দেখতে পাওয়া যায়।।নানারকম স্ট্রিট ফুড যেমন মোমো এবং থোকমার জন্য প্রসিদ্ধ।।
শিলং–এর উপর আরোও তথ্য
উমিয়াম হ্রদের কাছাকাছি খুব বেশি হোটেল এবং খাবারের দোকান নেই। সুতরাং নিজেরাই নিজেদের খাবার নিয়ে যাওয়াটা বেশ ভালো ধারণা।
লৈৎলাম-এ পৌঁছে, আপনার গাড়ির চালকের কাছে স্মিট নামের জনপ্রিয় গ্রামটির কথা উল্লেখ করুন। লৈৎলাম, স্মিট থেকে খুব বেশি হলে ছয় মাইলের দূরত্ব।
লৈৎলাম-এ পরিভ্রমণের সময় সচরাচর জলের বোতল ও একটি লেবু সঙ্গে করে নিয়ে যান (অনেক সময় উচ্চতার কারণে আপনার বমন উদ্রেককর অনুভূতি হতে পারে)।
শহরটির সমস্ত প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলির বেশীরভাগই পরিদর্শন করার পূর্বে, যাওয়া-আসার ক্যাব অগ্রিম-বুকিং করে রাখুন, কেননা কাছাকাছি গ্রামগুলিতে ক্যাবগুলির উপলব্ধতা সম্পর্কে কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)