লক্ষ্ণৌ ভ্রমণ-

লক্ষ্ণৌ (Lucknow) ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী হল লক্ষ্ণৌ । এই শহরকে বলা হয় তেহজিব এর শহর আর নওয়াব ওয়াজেদ আলি শাহ এর শহর। তেহজিব শব্দের আভিধানিক অর্থ হল আদবকায়দা। এই শহরের অধিবাসীরা অনেক ওয়েল ম্যানারড। লখনউ মানেই আভিজাত্যে মোড়া ইতিহাস। স্থাপত্যের খিলানে লেখা নবাবি কীর্তিগাথা। আর বাঙালির কাছে লখনউ মানেই বাদশাহী আংটির রহস্যভেদ। লক্ষ্ণৌ উত্তরপ্রদেশের একটি প্রধান শহর। এটি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্দ্ধিত শহর। লক্ষ্ণৌ প্রশাসণিক, শিক্ষা, ব্যবসা, কমার্স, টেকনলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল, পর্যটন, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, কবিতা, সাহিত্য সমৃদ্ধ শহর। উত্তর প্রদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হল লক্ষ্ণৌ। এটি বড় ইমামবাড়া,ছোটা ইমামবাড়া ও দি রেসিডেন্সির জন্য জনপ্রিয়। লক্ষ্ণৌ চিক্কনের জন্য লক্ষ্ণৌ বিখ্যাত। প্রচুর পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।

লক্ষ্ণৌ এর দর্শনীয় স্থান

বড় ইমামবাড়া

লক্ষ্ণৌর অবশ্যই ভ্রমন করা পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম বড় ইমামবাড়া। গোমতিনদীর তীরে গোমতি নগরে এটি অবস্থিত। ১৭৮৪ সালে তৎকালীন নবাব আসাফ উদ দৌল্লা এই ইমারতটি নির্মান করেছিলেন। বড় ইমামবাড়া শব্দটি উর্ধু শব্দ থেকে এসেছে। বড়া শব্দটির অর্থ ‘বড়’ এবং ইমামবাড়া শব্দটির অর্থ  ‘পবিত্র জায়গা’।  বড় ইমামবাড়া লক্ষ্ণৌ শহরের একটি বিখ্যাত মনুমেন্ট। এটি আসফি ইমামবাড়া হিসেবেও পরিচিত।  এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি বিশেষ পবিত্র ভূমি। বিশেষ করে সিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত মুসলিমদের জন্য। মহরমের সময় কয়েক হাজার মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে জড়ো হয়। ইমামবারার ভেতর  ইটের তৈরী ৫০ মিটার দীর্ঘ হল ঘর বর্তমান। যদিও এর কোনো সেই অর্থে গঠনতান্ত্রিক সাপোর্ট নেই। বড় ইমামবাড়ার ভিতর আসিফি মসজিদ,শাহি বাওয়ালি ইত্যাদী রয়েছে। ইমারতের ভেতর ভুলভুলাইয়া বর্তমান।  এখানে ১০২০ টি সুরঙ্গ বা টানেল আছে। এরমধ্যে ২ টি ছাদে পৌছিয়েছে। এই ইমারত তৈরী করতে কোন কাঠ বা অন্য কোনো ধাতু ব্যবহৃত হয় নি। এটি লক্ষ্ণৌর খুব আকর্ষণীয় জায়গা। ইহার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্তমান। প্রচুর পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।

ভুলভুলাইয়া

বড়ে ইমামবাড়ার ঠিক উপরেই আছে বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া। কথিত আছে, নবাব নাকি বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার জন্য এটি তৈরি করেছিলেন। তবে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এ স্থাপত্যেরও আসল উদ্দেশ্য সেনার আক্রমণ প্রতিহত করা। ত্রি-মাত্রিক জ্যামিতিক স্থাপত্যের এমন নিদর্শন দ্বিতীয়টি মেলা ভার। সতেরো শতকে ভারতে জ্যামিতি তথা অঙ্কশাস্ত্র কতটা উন্নত ছিল তা এই স্থাপত্য থেকে সহজেই অনুমেয়।

ছোটা ইমামবাড়া

লক্ষ্ণৌর একটি আকর্ষণীয় জায়গার নাম ছোটা ইমামবাড়া। এটি পুরাতন লক্ষ্ণৌর একটি সুন্দর ও ঐতিহাসিক জায়গা। এটি বড়া ইমামবাড়ার পাশেই অবস্থিত। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি বিশেষ পবিত্র ভূমি। বিশেষ করে সিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত মুসলিমদের জন্য। ১৮৩৮ সালে তৃতিয় নবাব মহম্মদ আলি শা এই ইমারতটি নির্মান করেছিলেন। মহরমের সময় কয়েক হাজার মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে জড়ো হয়। ওই সময় ছোটা ইমামবড়া ইমারতটি সাজানো হয় এবং রাতে মোমবাতি দিয়ে জ্বালানো হয়। দূর থেকে তখন ছোটা ইমামবড়া অসাধারণ দেখতে লাগে। প্রচুর পর্যটক ছোটা ইমামবড়া ভ্রমণ করেন।    

দিলখুশা কুঠি

লক্ষ্ণৌর এই পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম দিলখুশ কোঠি। ১৮০০ সালে ব্রিটিশ মেজর গোরে কুসেলি এই দিলখুশ কুঠির তৈরী করেছিলেন। এটি আবার ইংলিশ হাউজ বা বিলায়েতি কুঠি নামে পরিচিত। এই মনুমেন্টটি অনেকটা অবশ্য ব্যারাক ধরনের। এটি তৈরী করতে ৫ বছর সময় লেগেছিল। ব্রিটিশ মেজর গোরে কুসেলি নবাব সাদ্দাত আলি খানের ভাল বন্ধু ছিলেন। এই স্থাপত্যটি নেওয়া হয়েছিল ইংল্যান্ডের দেলাভেল হল থেকে। মনুমেন্টটি প্রাথমিক ভাবে নবাবদের শিকার ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নবাবরা এটিকে গ্রীস্মাবাশ বা ফার্ম হাউজ হিসেবে ব্যবহার করতেন। এটি লক্ষ্ণৌর অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা।

আম্বেদকর পার্ক

লক্ষ্ণৌর একটি অবশ্য ভ্রমন করা পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম আম্বেদকর পার্ক। গোমতি নদীর তীরে গোমতি নগরে এটি অবস্থিত। এখানে মার্বেল পাথড়ের স্থাপত্য শিল্প। দিনের বেলায় সূর্যের কিরণে দেখতে ভাল লাগে। জায়গাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পুরোটাই সুন্দর ভাবে মার্বেল দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। এটি লক্ষ্ণৌর একটি অন্যতম সেরা ভ্রমণের জায়গা। এটি উত্তরপ্রদেশে তৎকালীন মায়াবতী সরকার গঠন করেছিলেন। এখানে ডঃ আম্বেদকর,মায়াবতী এবং ৬২ টি হাতির মূর্তি রয়েছে। টিকিট মূল্য ১০ টাকা।

দি রেসিডেন্সি মিউজিয়াম

লক্ষ্ণৌর একটি অন্যতম সেরা ভ্রমণ স্থানের নাম দি রেসিডেন্সি ও মিউজিয়াম। এটি শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। ১৮০০ সালে এখানে অনেকগুলি ইমারত গঠিত হয়। এই ইমারতটি নির্মান করেন নবাব সাদ্দাদ আলি খানের প্রতিনিধি ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জেনারেল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। এই সময় এটি বিখ্যাত হয়েছিল। এই সময় এটি সকল ইউরোপিয়ানদের এখানে বসবাসের জায়গা করে দিয়েছিল। এর একটি ঐতিহাসিক দিক রয়েছে। রেসিডেন্সির ভেতর একটি মিউজিয়াম রয়েছে।

রুমি দরওয়াজা  

লক্ষ্ণৌর আরো একটি আকর্ষণীয় ভ্রমন স্থানের নাম রুমি দরওয়াজা। এটি লক্ষ্ণৌর একটি আকর্ষণীয় প্রবেশপথ। ১৭৮৪ সালে আসফ উদ দৌলাহর সমর্থন নিয়ে এটি তৈরী করা হয়েছিল। রুমি দরওয়াজার উচ্চতা ৬০ ফিট। এটি লক্ষ্ণৌর শহরের অর্ভ্যন্তরে লাজপত নগরে অবস্থিত।

লক্ষ্ণৌ শহরে একটা সময় ছিল বাঈজিদের রমরমা৷ ঘুঙুর আর ঠুমরি-র আওয়াজে তখন মাতোয়ারা থাকতো বাঈজি গলি৷ এখন আর সেই আওয়াজ পাওয়া না গেলেও এই গলির দু-পাশে লক্ষ্ণৌ আতরের গন্ধে চারপাশ ভরে থাকে৷ আতর বাদে এই শহরের আর যার গন্ধ পাওয়া যায় সারা দিন-রাত তা হল বিরিয়ানি আর কাবাবের গন্ধ৷ কাকোরি-শামি-বটি কাবাবের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে লক্ষ্ণৌ ঘরানার বিরিয়ানির গন্ধ৷ লক্ষ্ণৌ বেড়াতে গেলে অবশ্যই শুধু গন্ধই নেবেন না, খেয়েও দেখবেন প্রায় অমৃত ৷

লক্ষ্ণৌ ঘোরার সেরা সময়

লক্ষ্ণৌতে গরমের সময় ভালই গরম পরে। এই সময় তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রীতে পৌছায়। আবার শীতে ভাল ঠান্ডা থাকে। শীতের তাপমাত্রা গড়ে ৮-২২ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। শীতকাল এখানে খুব আরামদায়ক আবহাওয়া থাকে। এখানে ঘোরার আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।

কিভাবে যাবেন

ট্রেন

কলকাতা থেকে লক্ষ্ণৌ যাওয়ার সরাসরি কয়েকটি ট্রেন রয়েছে। 

  • অকাল তখত এক্সপ্রেস ১২৩১৭(সুপার ফাস্ট) কলিকাতা..সকাল ৭.৪০-লক্ষ্ণৌ  রাত ২.৪১ সপ্তাহে ২ দিন, সময় ১৯.০১ঘন্টা।
  • কুম্ভ এক্সপ্রেস ১২৩৬৯(সুপার ফাস্ট) .. হাওড়া ..দুপুর ১.০০- লক্ষ্ণৌ সকাল ৭.১৫ সপ্তাহে ৫ দিন, সময় ১৮.১৫ ঘন্টা।
  • শিয়ালদহ জম্মু তাওয়াই হামসফর ২২৩১৭(হামসফর) শিয়ালদহ.. দুপুর ১.১০- লক্ষ্ণৌ  সকাল ৬.১০, সপ্তাহে ১ দিন, সময় ১৭.০০ঘন্টা।
  • কলিকাতা জম্মু তাওয়াই এক্স্র্রেস এক্সপ্রেস ১৩১৫১(এক্সপ্রেস) কলিকাতা.. সকল ১১.৪৫- লক্ষ্ণৌ  দুপুর ১২.৩৫, সপ্তাহে প্রতিদিন, সময় ২৪.৫০ ঘন্টা।
  • উপাসনা এক্সপ্রেস ১২৩২৭(সুপার ফাস্ট) হাওড়া.. দুপুর ১.০০- লক্ষ্ণৌ  সকাল ৭.১২, সপ্তাহে ২ দিন, সময় ১৮.১২ ঘন্টা।

গাড়ি

লক্ষ্ণৌ থেকে গাড়ি ভাড়া করে আপনি সহজেই পৌছে যাবেন কুমায়ূন/ নৈনিতাল/ পিথড়গড়/অযোধ্যা/কানপুর/আগ্রা/ঝাঁসি/মথুরা/এলাহাবাদ/বৃন্দাবন/কাশি ইত্যাদী জায়গায়। রাস্তা কমবেশী ভাল। আপনি সহজেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছিয়ে যাবেন।

খাওয়া দাওয়া  

লুচি,ডাল,ভাত, বিভিন্ন সব্জি, চিকেনের নানা ডিস, মাছ এখানে সহজলব্ধ। রেট খুব সস্তা না হলেও খুব দামিও নয়।   

স্পেশাল খাওয়ার

কাবাব, বিরিয়ানী, কুলফ ফালুদা, কেশরি পেড়া, শাহি টুকড়া, কুলচে নিলহারি, শিরমল, চিকেন শরমা, নৈনিতাল মোমো, মালাই  মাখম, ভেজ কাবাব পরোঠা

লক্ষ্ণৌর বেশ কিছু রেস্ট্রুরেন্ট

মহালক্ষ্মী সুইটস, দি ইয়েলো চিলি, মধুর মিলন, মেইনল্যান্ড চায়না, ৭ স্পাইস রেস্ট্রুরেন্ট, দি পিকাডিলি, দশপ্রকাশ, পাইরেটস অফ গিলস, ফলক নুমা রেস্ট্রুরেন্ট, বৃন্দাবন, মুবিন’স, তুন্ডে কাবাব, স্পাইস কেভ, নবাব’স, মুমন’স রয়্যাল কাফে, ভিনটেজ মেশিন, আজরাক, ছোটে নবাব, ঔধ্যনা, বিরিয়ানী, দস্তরখান, আরবান টেরেস, এল-১৪, দ্যা আরবান ধাবা

হোটেল

লক্ষ্ণৌ প্রচুর হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে। হোটেলের ঘর ভাড়া কমপক্ষে ৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। এখানে দেয়া সব হোটেলের ঘর ভাড়া ৮০০ টাকার নীচে। সিজনের সময় ঘর ভাড়া বেড়ে যায়। শীতের সময় সিজন ছাড়া আপনি বুক না করেও যেতে পারেন।

কিছু হোটেলের নাম

মিনি এলিট সুট, জলসা রিসোর্ট, হোটেল রাজ শ্রী, হোটেল অলিভ ট্রি, হোটেল সুমিত্রা, হোটেল প্রকাশ ডিএক্স, এলিট গেস্ট হাউজ, রূপ গেস্ট হাউজ, নির্মল প্যালেস, হোটেল ম্যাক্স, হোটেল মহালক্ষ্মী ইন, অমিত হোটেল, পথিক হোটেল, হোটেল মঙ্গলম ইন, মনবোধ নিবাস,হোটেল এসআরজি, হোটেল বাবা সোনরাইজ, হোটেল বিজয়, সুমন নিবাস।

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না, চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ