নীলাদ্রি লেক-
নীলাদ্রি -নীল রঙে রূপায়িত এক জায়গার নাম। এ যেনো নীলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। দেখে মনে হয়, স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরা জায়গাটা যেন বাংলাদেশের মাঝে এক টুকরো ’কাশ্মীর’! সুন্দর ও নয়নাভিরাম জায়গা যা মনকে মুহূর্তেই দোলা দিয়ে যায়! এমনই একটি জায়গা টেকেরঘাট চুনাপাথরের পরিত্যাক্ত খনির লাইমস্টোন লেক। পর্যটকরা একে নীলাদ্রি লেক বলেই জানে। এর নামটা যেমন সুন্দর রূপটাও তেমনি মোহনীয়। শহীদ সিরাজ লেক / নীলাদ্রি লেক ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের উপজেলা তাহিরপুরে অবস্থিত একটি লেক। প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক, যদিও লোকে নীলাদ্রি নামে চেনে। নীলাদ্রি লেক মূলত চুনাপাথরের পরিত্যক্ত লাইমস্টোন লেক। নীল স্বচ্ছ জলের চোখজুড়ানো সৌন্দর্যের কারণে এটি ‘নীলাদ্রি’ নামে পরিচিত। নীলাদ্রি লেককে অনেক পর্যটক ‘বাঙলার কাশ্মির’ বলে অভিহিত করে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। মাঝখানে নীল রঙের জল। একপাশে মেঘালয়ের পাহাড়, তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাথর। প্রকৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। দেশের মধ্যেই যেনো টুকরো কাশ্মীর। স্বর্গীয় সৌন্দর্য আর মনোরোম দৃশ্যে ভরপুর এক স্থান হলো নিলাদ্রি লেক। নীলাদ্রি লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আপনি নৌকা পাবেন। জলে অবগাহনের সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পাহাড়ের ওপর জন্মানো কলাপাতার সঙ্গে বাতাসের সম্মিলিত সুর সংগীত শুনতে পাবেন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের এই লেকটি গত ৩ বছরে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লেকটি পড়েছে বাংলাদেশে আর লেক পাড়ের পাহাড় পড়েছে ভারতে। লেকের আশপাশে অসংখ্য ছোট ছোট টিলা। আরেকটু এপাশে এলেই বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওড়। ঘাসে ঢাকা সবুজ টিলা, লেকের টলটলে পানি, ওপারে নীলচে পাহাড় সব মিলিয়ে এক নজরেই মন বলে ওঠে ‘অসাধারণ’! স্বর্গীয় শান্তির বাস এই লেকে। স্বচ্ছ নীল জলের জন্য লোকমুখে লেকটি নীলাদ্রি নামেই পরিচিত। পারস্য কবি আমির খসরুর কবিতার একটি লাইন মনে পড়বে-‘যদি স্বর্গ কোথাও থাকে, তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই।’ভ্রমণকারীরা ছবি দেখে হন্যে হয়ে ছুটে আসেন এখানে, ক্যাম্পিং করেন কখনো জ্যোৎস্না রাতে, কখনো বা তারা ভরা আকাশের নিচে। টেকের হাটে যাওয়ার পথটা বেশ সুন্দর। টেকেরহাট যাওয়ার পথে চারিদিকের মুগ্ধতায় বিমোহিত হয়ে সময় কোন দিকে দ্রুত চলে যাবে টেরই পাওয়া যাবে না। নীলাদ্রির প্রাকৃতিক অপরূপ দৃশ্যের সমাহার দেখতে দেখতে বাংলাদেশের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাবেন একসময়। দেখা মিলবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মোহনীয় সৌন্দর্য। কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর পর আবার টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘোরার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠতে পারেন। নৌকাগুলোর ভেতরে বিছানা-বালিশসহ বলতে গেলে বিশ্রাম নেয়ার মতো আরামদায়ক সুন্দর ব্যবস্থা থাকে।
বসন্তকালে প্রকৃতি যখন নবরূপে সতেজ সাজে নিজেকে সাজায়, ঠিক তখনই ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণের টানে বেরিয়ে পড়ার হিড়িক আসে। মন আনচান করে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে, যার অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাগতিক ক্লান্তি মুছে দিয়ে মনকে করবে চাঙা। জীবনকে করবে আরও উৎফুল্লময় ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। তাই বলছি, এবারের বর্ষায় ঘুরে আসতে পারেন সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, বারিক্কা টিলা, শিমুলবাগান, জাদুকাটা নদী, নীলাদ্রি লেক।
ইতিহাস
জানা যায়, চুনাপাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সিরাজ লেক ও টিলার সৃষ্টি। চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের পরিত্যক্ত এই খোয়ারী থেকে ১৯৪০ সালে চুনাপাথর সংগ্রহ শুরু ।। এখানে চুনাপাথর সংগ্রহ করে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় নির্মিত আসাম বাংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো হতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এর সব কার্যক্রম। এরপরে ১৯৬০ সালে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখার জন্য চুনা পাথরের প্রয়োজনে ভূমি জরিপ চালিয়ে সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট এলাকায় ৩২৭ একর জায়গায় চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ।পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে খনিজ পাথর প্রকল্পটি মাইনিংয়ের মাধ্যমে র্দীঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই প্রকল্পটি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোয়ারী থেকে চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অর্থায়নে শহীদ সিরাজ লেকের উন্নয়নকাজের ভিত্তিপ্রস্তর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাবিরুল ইসলাম। পরে লেকসহ পুরো এলাকায় পর্যটকদের বসায় চেয়ার, বাচ্চাদের দোলনা স্থাপন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামানুসারে এই হ্রদের নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ হ্রদ। মো. সিরাজুল ইসলাম ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার ফিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্নাতকে পড়াকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘর ছাড়েন সিরাজ। আসামের ইকো ওয়ান সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব-সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তিনি। স্বাধীনতার পর শহীদ সিরাজকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
ভ্রমণ পরিকল্পনা
নীলাদ্রী লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারেক টিলা এবং টাঙ্গুয়ার হাওরের দূরত্ব কাছাকাছি হওয়ায় আপনি চাইলে সময় ভাগ করে পছন্দের জায়গাগুলো দেখে ফেলতে পারবেন। সাধারণত বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণ বেশি উপভোগ্য তাই বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওর সহ নীলাদ্রী লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারেক টিলা ভ্রমণ করতে পারেন।
অনেকেই সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওর দেখতে যান। কিন্তু এর আশেপাশেই অনেক সুন্দর সুন্দর নয়নাভিরাম জায়গা আছে যা যেকোন পর্যটকের মনকে মুহূর্তেই দোলা দিয়ে যেতে পারে ! এমনই একটি যায়গা টেকেরঘাট চুনাপাথরের পরিত্যাক্ত খনির লাইমস্টোন লেক। স্থানীয় লোকজন একে নীলাদ্রি লেক বলেই জানে । এর নামটা যেমন সুন্দর এর রূপটাও তেমনি মোহনীয় । নিজ চোখে না দেখলে হয় বিশ্বাসই করতে পারবেননা পানির রঙ এতটা নীল আর প্রকৃতির এক মায়াবী রুপ। মাঝের টিলা গুলা আর ওপাড়ের পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশ এর শেষ সিমানা। বড় উচু পাহাড়টিতেই সীমানা কাটা তারের বেড়া দেওয়া
কোথায় থাকবেন
বড়ছড়া বাজারে পাবেন বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউজ। এই সব গেস্ট হাউজে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে রুম পাবেন। তাহিরপুর বাজারেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নীলাদ্রি লেকের কাছে বছরাতে নীলাদ্রি আবাসিক গেস্ট হাউজ রয়েছে। সেখানে ৪০০ টাকায় এক রুম পাওয়া যায়। এছাড়া টেকেরঘাট বাজারে একটি হোটেল রয়েছে খন্দকার হোটেল। তাছাড়া, পুরাতন চুনা পাথরের কারখানার গেস্ট হাউজেও রাত কাটাতে পারবেন।
কোথায় খাবেন
খাওয়া-দাওয়া টেকেরঘাট বাজার, বড়ছড়া বাজার বা তাহিরপুর বাজারে করতে পারবেন। সেখানে বেশ কয়েকটি ভালো মানের খাবারের হোটেল পাবেন। আর নৌকা ভাড়া নিলে সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা থাকে। সেক্ষেত্রে নৌকায় ওঠার আগে বাজার করে নিতে হবে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জ যেতে হবে প্রথমে। এরপর মোটরসাইকেল বা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে তাহিরপুর উপজেলা অথবা লাউড়েরগড় যেতে হবে। সেখান থেকে হেঁটে এগোলেই যাদুকাটা নদী ও বারিক্কা টিলা। এরপর মোটরসাইকেল ভাড়া করে সীমান্ত দিয়ে টেকেরঘাট। বর্ষায় তাহিরপুর থেকে নৌকায় যাওয়া যায়। এজন্য সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। শুকনো মৌসুমে ভাড়ায় মোটরসাইকেলে টে কেরঘাট যাওয়া যায়।
সাবধানতা
সীমান্ত এলাকা তাই সাবধানে থাকতে হবে। সীমানার খুব কাছাকাছি না যাওয়ার চেষ্টা করাই ভালো। আর সাঁতার না জানলে লেকের পানিতে না নামাই ভালো। নামলেও বেশি দূরে যাবেন না। কারণ এখান থেকে এক সময় প্রচুর পরিমানে চুনা পাথর উঠানো হতো। যার ফলে লেক অনেক গভীর।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার।। হ্যাপি_ট্রাভেলিং]
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)