দার্জিলিং ভ্রমণ-

দার্জিলিং (Darjeeling), সস্নেহে “শৈল শহরের রাণী”- হিসাবেও পরিচিত, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দার্জিলিং তার চা-উৎপাদন ও দার্জিলিং-হিমালয় রেলপথের জন্য সু-প্রসিদ্ধ; যেটি আবার ইউনেস্কো (ইউ.এন.ই.এস.সি.ও)-র একটি পৃথিবীর ঐতিহ্যগত স্থান। দার্জিলিং সর্বদাই তার নিদারুণ সৌন্দর্য্য ও মনোরম জলবায়ুর কারণে ভারতের এক জনপ্রিয় অবকাশ-যাপনের গন্তব্য। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির মতো সুন্দর শহর এই দার্জিলিং। দার্জিলিং-এ মনোরম আবহাওয়া ও নিদারুণ সৌন্দর্য্য ছাড়াও, এখানে প্রচুর দর্শনীয় জিনিস রয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য এবং টাইগার হিলের চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য প্রতিবছর হাজার পর্যটক এখানে ভিড় করেন।

ভারতের অন্যতম সুন্দর জায়গা দার্জিলিংয়ে অপেক্ষা করছে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সরু রেললাইন ধরে উপরে উঠে যাওয়া হিমালয়ান রেলওয়ের টয় ট্রেন। এক টয় ট্রেন দিয়েই অনেকে দার্জিলিংকে চেনে। আবার শুধু টয় ট্রেনই আছে দার্জিলিংয়ে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়। শীতকালে দার্জিলিংয়ের উচ্চতায় এক কাপ দার্জিলিং চা নিয়ে বসে আরামে সবুজের বিশালতা উপভোগ করার যে অভিজ্ঞতা তা খুব কম মানুষই হাতছাড়া করে।  

পুরো দার্জিলিং শহরটাই ছবির মতো সুন্দর, টাইগার হিলে ভোররাতে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সূর্যকে উদয় হতে দেখবেন। সাদা বরফের রাজ্যে লালের অনুপ্রবেশের সেই মোহনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হতে হাজারো মানুষ ছুটে যায় শেষরাতের ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে। এই দৃশ্য দেখতে হলে রাত তিনটায় হোটেল থেকে বেরুতে হবে, জিপ রিজার্ভ করে রাখতে হবে আগে থেকেই।

দার্জিলিং এর দর্শনীয় স্থান

দার্জিলিং জুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে এখানে। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায় এখানে। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি, ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ। বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ স্নো লুপার্ড খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা,পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’,এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ, কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।

হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের অপূর্ব অভিজ্ঞতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত মনোরম খেলাধুলার স্থান দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম। নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম। পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’ অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’। শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’। এসব নিদর্শন তো রয়েছেই সাথে আপনার মনের চিরহরিৎ জগতকে এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করাতে

চলে যেতে পারেন পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’ এবং গঙ্গামায়া পার্কে উপরোল্লিখিত দর্শনীয় স্থানগুলোতে । এছাড়াও আপনার হৃদয় গহিন থেকে রোমাঞ্চিত করবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা ‘কাঞ্চন-জংঘা’, বিশুদ্ধ পানির অবিরাম ঝর্ণাধারা ‘ভিক্টোরিয়া ফলস্’ এবং মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।

টাইগার হিল 

২,৫৯০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত টাইগার হিল দার্জিলিং থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মাউন্ট এভারেস্টের একটি দর্শনীয় দৃশ্য দেখতে পাবেন। একদম ভোরে টাইগার হিল-এ গিয়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার মতো। ১৯৫৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডুর স্মৃতির উৎসর্গে নির্মাণ করা হয়েছিলো এই চিড়িয়াখানাটির। এই চিড়িয়াখানায় বন্য নেকড়ের বৃদ্ধির উত্থাপন করা হয়। তাছাড়া এই জায়গা বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী যেমন : সাইবেরীয় বাঘ, লাল পাণ্ডা এবং তুষার পাহাড়ি চিতার আবাসস্থল।

ধীরধাম মন্দির

ভারতীয় উপ-মহাদেশের যেকোনো প্রান্তে গেলে অবশ্যই একটি প্রাচীন শিব মন্দির খুঁজে পাবেন। ধীরধাম মন্দিরটি ‘টয় ট্রেন’ রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক উপরে। এই মন্দিরটি খুবই সুন্দর। বর্ণময় মন্দিরের এই ভবনটি হিন্দুদের চাইতে জনপ্রিয় দেবতা, শিবের নিবাসস্থল। দার্জিলিং শহরের সবচাইতে প্রাচীনতম মন্দির এটি।

বাতাসিয়া লুপ 

অসম্ভব সুন্দর এর জায়গাটি টাইগার হিলে যাওয়ার পথেই পরবে। গোর্খা আর্মিদের একটি স্মৃতি স্তম্ভ মাঝে আছে। দার্জিলিং-এর ‘টয় ট্রেন’ এখানেই ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরে আবার যায় ঘুম ষ্টেশনের দিকে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তাছাড়া বাইনোকুলার সাথে নিয়ে গেলে এখান থেকে হিমালয় অন্নপূর্ণা, পর্বত, চায়না এবং নেপাল বর্ডার দেখতে পারবেন। এখানে পুরো জায়গাজুড়ে ফুলের বাগান যা আপনার শুধু দেখতেই সুন্দর নয় বরং বাগানগুলো আপনার মনে প্রশান্তিও এনে দিবে বটে।

দার্জিলিং রুপওয়ে/ক্যাবল কার 

দার্জিলিং ক্যাবল কার, চা-বাগান থেকে ফেরার পথে তেঞ্জিং রক পাড় হলেই দেখতে পাবেন। এখানে ক্যাবল কারে চড়তে খরচ হবে ১৫০ টাকা। দৈর্ঘ্যে ক্যাবল কারগুলো অনেক বড়, এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে যেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। এছাড়াও অন্য পাড়ে গিয়ে নামতে পারবেন। কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিয়ে টুকটাক এবং সাথে চা/কফিও খেয়ে নিতে পারেন। এর পাশাপাশি এখানে দাঁড়িয়ে চা বাগানের দৃশ্যসহ মনোরম পাহাড়ি দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। ক্যাবল কারে চড়ার সময় চারিদিকের চোখ জুড়ানো দৃশ্য, চা-বাগান, পাহাড়ি কোনও ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ার শব্দও উপভোগ করতে পারবেন।   

টয় ট্রেন

টয় ট্রেন খ্যাত সরু রেলপথটি প্রায় ২ ফুট প্রশস্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,২০০ ফুট উপরে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে সপ্তাহের প্রতিদিন যাত্রীবাহী ট্রেনটি যাতায়াত করে। এতে রয়েছে একটি বিশেষ পর্যটন ট্রেন যা দার্জিলিংকে দেশের সর্বোচ্চ ট্রেন স্টেশন ঘুমের সাথে যুক্ত করে। এই ট্রেন ভ্রমণটি বিশ্বের সবচেয়ে মনোরম পর্বত রেলওয়ে সার্কিটগুলোর একটি হিসাবে পরিচিত। রেলভ্রমণে মনোরম গ্রাম, চা বাগানের সবুজ চাদর, স্নেহময় সবুজ উড়ালভূমি, আর পাহাড় সম্রাট  হিমালয়ের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে। পুরো ভ্রমণটা শুধু মনকে নয় বরং চোখের প্রশান্তিও দিবে।

রক গার্ডেন 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত পর্যটন আকর্ষণ। দার্জিলিং থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে উদ্যানটি অবস্থিত। ঘুম স্টেশনের পূর্বে ডানদিকে মোড় নিয়ে রক গার্ডেন যাওয়া যায়। 

গঙ্গা মায়া পার্ক
গঙ্গা মায়া পার্কটি রক গার্ডেন থেকে প্রায় 3 কিলোমিটার (1.9 মাইল) রাস্তার নিচে। জিএনএলএফ-এর আন্দোলনের সময় পুলিশ নিরপরাধ শিকারের নামানুসারে নামকরণ করা, “এটি একটি কোর্লিং পর্বতমালা, অতীত গাজাবোস, ফুলের ঝোপঝাড় এবং গাছের গুঁড়ো, কোঁ-কার্পের তলদেশের নীচে ও কুঁচকানো ব্রিজের উপর দিয়ে পড়ে এবং একটি বৃত্তাকারে পরিণত হয়। প্যাডেল বোট এবং একটি জলপ্রপাত সহ হ্রদ। ” এটিতে একটি ছোট লেক রয়েছে যেখানে নৌকা বাইচ সুবিধা রয়েছে। পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার জন্য গোর্খা লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়।

কেনাকাটা
দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের কোল ঘেঁষেই রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসই আপনি পেয়ে যাবেন এখানে এবং তা আপনার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই। সবচেয়ে ভালো যা পাবেন তা হল শীতের পোশাক। আপনার পছন্দমতো মূল্যে হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ যে কোনো প্রকারের লেদার জ্যাকেট পেয়ে যাবেন এখানে। এছাড়াও  ১০০ থেকে ৫০০ রুপির মধ্যেই পেয়ে যাবেন অসাধারণ কাজ করা নেপালি শাল এবং শাড়ি যা কি না  আপনার পছন্দ হতে বাধ্য।

দার্জিলিং ভ্রমনের উপযুক্ত সময়

দার্জিলিং পরিভ্রমণের সেরা সময় হলো শরৎ ও বসন্তকাল। দার্জিলিং -এ বসন্ত কাল মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিরাজ করে অন্য দিকে শরৎ কাল সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্থিত হয়।

ভ্রমন খরচ
অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলে স্বল্প খরচে ঘুরে আস্তে পারেন দারজিলিং।শীত মৌসুমে মাত্র ১৬,০০০ টাকার মধ্যেই আপনি সেরে নিতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিং দেখার যাবতীয় কার্যক্রম।

খাবার-দাবার
ট্যুরিস্টদের জন্য হোটেলগুলোতে রয়েছে সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা। ফলে পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার নেই কোন কারণ। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে একেবারে বাঙালি রুচিসম্মত খাবার-দাবারের জোগান দিয়ে থাকেন এখানকার হোটেল মালিকরা। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ছাড়াও ভোরবেলায় বেড-টি এবং ডিনারের আগে ইভনিং-টি’র ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।

কীভাবে যাবেন

আপনার ভারতীয় ভিসার পোর্ট যদি বুড়িমারি চেংড়াবান্ধা দেয়া থাকে তবে প্রথমেই ঢাকার শ্যামলি বা গাবতলি থেকে হানিফের বাসের টিকেট কেটে নিন বুড়িমারি পর্যন্ত, ভাড়া ৬৫০ টাকা। একদম বুড়িমারি বর্ডারের কাছেই বাস থামবে। ইমিগ্রেশন পার করে ওপাশ থেকে অটো নিয়ে চলে যাবেন বিশ্বরোড, সেখান থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস পাবেন, ভাড়া ৬০ রুপি। বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগবে প্রায় দু’ঘণ্টা। শিলিগুড়ি থেকে শেয়ারে জীপ পাবেন দার্জিলিং যাওয়ার জন্য, ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কোথায় থাকবেন

দার্জিলিং -এ বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল ও হোমস্টে রয়েছে। বাজেট হোটেলের মধ্যে টাওয়ার ভিউ,দেজং রেট্রেট, এভারেস্ট গ্লোরি, কি কিবা ধী, হোটেল ইভি, ক্যাসেল, পাহাড়ি সোল, বেনু’স এর মতো হোটেলে গুলোতে ৬০০-৮০০ এর মধ্যে রুম পাওয়া যায়। একটু বেশি বাজেটের মধ্যে হলে নিউ সিঙ্গালিয়া পার্ক হোমস্টে, হিমশিখা হোমস্টে, ফ্রাতেরনিতি হোমস্টে, মাউন্টেইন হোমাস্টে, গুলোতে ১০০০-২০০০ এর মধ্যে রুম পাওয়া যায়।।

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ