জয়পুর ভ্রমণ-
জয়পুর (Jaypur) হলো ভারতের রাজস্থান প্রদেশের রাজধানী এবং সবচাইতে বড় শহর। পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে এ-এক অন্যরকম রাজধানী। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলসের আগমনে গোটা শহরকে আতিথেয়তার গোলাপি রঙে সাজিয়েছিলেন মহারাজ রাম সিং। সেই থেকে জয়পুর ‘গোলাপি শহর’। জয়পুর মুঘল পতনের পর অম্বর পাহাড় থেকে নিচে সমতলে ১৭২৭-এর ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর। সপ্তদশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই শহরটি ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় আছে। আমের এর শাসক দ্বিতীয় জয় সিংহ এই শহরটি স্থাপন করেন। এর আগে জয় সিংহ মুঘলদের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মুঘলদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হলে জয় সিংহ রাজধানী স্থানান্তর করেন। ফলস্বরূপ ১৭২৭ সালে জয়পুর এর জন্ম হয়। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নামক একজন বিখ্যাত বাঙালি স্থপতিকে দায়িত্ব দেন এই নগরের নকশা করার। তাঁর নিরলস পরিশ্রমে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পিঙ্ক সিটি খ্যাত জয়পুর।
জয়পুর এর দর্শনীয় স্থান
জয়পুর এ অনেক চমৎকার কিছু জায়গা আছে যেখানে ঘুরে আপনি বর্ণিল অভিজ্ঞতা পেতে পারেন। জয়পুর প্রধানত দুই ভাগে বিভক্তঃ পুরনো শহর আর নতুন শহর। জয়পুরের পুরনো অংশ কে পিংক সিটি বলা হয়ে থাকে। জয়পুরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই এলাকাটি সপ্তাদশ ও অষ্টাদশ শতকের স্থাপনা দ্বারা পরিপূর্ণ। এখানে বেশ কিছুদিন না থাকলে সব কিছু দেখে শেষ করতে পারবেন না। জয়পুরের নতুন অংশটিও একেবারে কম পুরনো নয়। উনবিংশ শতাব্দিতে রাজা রাম সিংহ শহর বর্ধনের পরিকল্পনা হাতে নেন। নতুন অংশে নাগরিকদের সুবিধার জন্য উন্নত পানি নিষ্কাশন ব্যাবস্থা, ডাক ব্যাবস্থা ইত্যাদি চালু করেন রাজা রাম সিংহ। এখানকার প্রাসাদ গুলোতে ইউরোপীয় ছাপ সুস্পষ্ট।
পিঙ্ক সিটি
জয়পুরের “পিঙ্ক সিটি” ভারতের বিখ্যাত সুবর্ণ ত্রিভূজ পর্যটন সার্কিটের অংশ এবং রাজস্থানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থলগুলির একটি। এর মধ্যে অনেক বিখ্যাত কাঁটায় ও প্রাসাদ রয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য এবং বিস্তৃত স্থাপত্য গর্ব করে।
সিটি প্যালেস
সাতটি প্রবেশ তোরণ নিয়ে মহারাজ সওয়াই জয় সিং ২-এর প্রাচীরে ঘেরা সিটি প্যালেস। মোগল ও রাজপুত ঘরানার স্থাপত্যশৈলি শ্বেতপাথরের মূর্ত হয়ে উঠেছে। স্থাপত্যকলার অসামান্য নিদর্শন মুবারক মহল। প্রাসাদের ঝুলন্ত দরজা আর জানলাগুলিতে অসামান্য হিন্দু ভাস্কর্য। জয়পুরের রাজারা বিশাল হল জলের চকে বসে প্রজাদের অভাব, অভিযোগ শুনতেন। দেওয়ান-ই-খাসের কাছেই দেওয়ান-ই-আম। তিনদিক খোলা বিশাল হলঘর।
যন্তর মন্তর
মহারাজ ২য় সওয়াই জয় সিং-এর তৈরি ৫টি মানমন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বড় এটি। বাকি চারটি দিল্লি, মথুরা, উজ্জয়িনী ও বেনারসে আছে।
হাওয়া মহল
গোলাপি বেলে পাথরে তৈরি মৌচাক আকৃতির পাঁচ তলা হাওয়া মহলের প্রতি তলায় সার সার জানালা। ১৭৯৯ সালে সওয়াই প্রতাপ সিং এটি তৈরি করেন। হাওয়া মহলে আছে ৩৫৬টি ঝরোখা। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে রাজপরিবারের মহিলারা যাতে একান্তে রাস্তার চলমান জীবন দেখতে পান সেই উদ্দেশ্য এটি বানানো হয়।
অম্বর প্যালেস
শহর থেকে ১১ কিমি দূরে রুক্ষ পাহাড়ের মাথায় ছবির মতো লাল বেলে পাথরের অম্বর প্যালেস। এখানেও রাজপুত ও মোগল স্থাপত্যশৈলির যুগলবন্দী ঘটেছে। রাজা মান সিং ১ ১৬ শতকে এটি তৈরি করান। গনেশ পোল দিয়ে রাজপ্রাসাদে ঢুকতে হয়। সুহাগ মন্দিরের জালির কাজ অসামান্য। চল্লিশটি স্তম্ভের ওপরে দাঁড়িয়ে দেওয়ান-ই-আম। তার ওপরে শ্বেতপাথরের গোলাকার গম্বুজের মহানিবাস। বাঁ দিকে দেওয়ান-ই-খাস।
অ্যালবার্ট হল মিউজিয়াম
১৮৬৭ সালে ইন্দো-সেরাসেনিক শৈলিতে তৈরি অ্যালবার্ট হলে গড়ে উঠেছে অপূর্ব এই সংগ্রহশালা। দেখতে পারেন রামনিবাস বাগের ইন্ডোলজি মিউজিয়ামটিও।
জল মহল
গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে মুক্তি পেতে ১৭৯৯-তে রাজা প্রতাপ সিং জলের মধ্যে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। নীল জলের মধ্যে হলুদ বেলে পাথরের এই প্রাসাদের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি তৈরি করে।
গোবিন্দ দেবজির মন্দির
গোবিন্দ মন্দিরের রাধা-গোবিন্দের মূর্তিটি চমত্কার। ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে যখন ভারত জুড়ে মন্দির ধ্বংস চলছে তখন রাজা জয়সিংহ কয়েকজন বাঙালি পুজারী-সহ গোবিন্দজিকে বৃন্দাবন থেকে জয়পুরে আনেন।
অন্যান্য
এ-ছাড়াও দেখতে পারেন ১৭৩৪ সালের নাহারগড় ফোর্ট, অষ্টাদশ শতকের জয়গড় ফোর্ট, লক্ষ্মী নারায়ণ বা বিড়লা মন্দির, গাইতোড়, শিশোদিয়া রানি প্যালেস ও গার্ডেন, জয়পুরের প্রধান স্থপতি বাঙালি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্মরণে বিদ্যাধর গার্ডেন, সেন্ট্রাল পার্ক, আনোখি মিউজিয়াম অফ হ্যান্ড প্রিন্টিং, অক্ষরধাম মন্দির, দিগম্বর জৈন মন্দির, গলতাজি, রাম নিবাস গার্ডেন ইত্যাদি।
কেনাকাটা
জয়পুর হাতে তৈরি তাঁতের জিনিসের জন্য বিখ্যাত। সংগ্রহ করতে পারেন রেজাই, বাঁধনি শাড়ি ও অন্যান্য। সব চেয়ে ভাল সরকারি শোরুম রাজস্থলী। এ ছাড়াও জোহারি বাজার, এম আই রোড, নেহরু বাজার ও বাপু বাজার কেনার জন্য সেরা। রবি বারে বাজার বন্ধ থাকে।
ভ্রমণের সেরা সময়
কোথাও যাবার আগে সেখানকার আবহাওয়ার আগাম খবর নিয়ে যাওয়া ভাল। জয়পুরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণই বলা চলে। তবে অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে গেলে অনেক ভাল একটা পরিবেশ পাবেন। তখন তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। জয়পুরের শীতকালও অনেক চমৎকার। এখানে শীতকাল শুরু হয় নভেম্বর থেকে আর শেষ হয় ফেব্রুয়ারিতে। এই সময়ের মধ্যে গেলে আপনি বেশ কিছু উৎসবেও অংশ নিতে পারবেন। যেমন জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভাল বা সাহিত্য সম্মেলন। মার্চে পাবেন জয়পুরের বিখ্যাত হাতি উৎসব বা এলিফেন্ট ফেস্টিভাল।
জয়পুরে কি খাবেন
ভারতের বেশিরভাগ এলাকাতেই মসলা প্রধান খাবার বেশ জনপ্রিয়। জয়পুরও এর ব্যাতিক্রম নয়। এখানকার খাবারের মধ্যে রাজপুত ও মুঘল রন্ধন প্রনালির বেশ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এখানকার কিছু বিখ্যাত খাবার হল ডাল কচুরি, টিকি, বেজাত রুটি, কিমা বাটি, চুরমা, লাল মাস, মিরচো বাদাস, জঙ্গলি মাস, পনীর আফতাব, সুলা বিরিয়ানি ইত্যাদি। এছাড়া রাজস্থানি স্টাইলে রান্না করা আমাদের পরিচিত যেমন মুরগি, খাসি এবং মাছের তরকারী তো থাকছেই। আরও আছে বিভিন্ন ধরনের ও স্বাদের বড়া। এছাড়া বিভিন্ন স্বাদের চা ও মণ্ডা মিঠাই তো আছেই।
কিভাবে যাবেন
রাত ১২.৩৫ মিনিটে চিতোরগড় থেকে ১৯৬৬৬ খাজুরাহো এক্সপ্রেস ধরে পরদিন ভোর ৫.৪৫ মিনিটে জয়পুর নামুন। দিনে দিনে আসতে চাইলে বেলা ৮.২০ মিনিটে ধরুন ১২৯৯১ জয়পুর এক্সপ্রেস। রাজধানী শহর জয়পুর যেতে বিলাসবহুল বা সাধারণ বাসও মিলবে।
কোথায় থাকবেন
রাজধানী শহর। হোটেলের কোনও অভাব নেই। রাজ্য পর্যটনের চারটি হোটেল আছে জয়পুরে। অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনের কাছে হোটেল গাঙ্গুর। রেল স্টেশনের বিপরীতে হোটেল স্বাগতম। জয়পুরের কিছু আন্তর্জাতিক আবাসিক হোটেল এর নামঃ
- আই সি টি রাজপুতনা
- দি ললিত হোটেল
- রামবাগ প্যালেস
- রয়্যাল হেরিটেজ হ্যাভেলি
- ভেস্তা ইন্টারন্যাশনাল
- জয়পুর ম্যারিয়ট হোটেল
- হলিডে ইন
- র্যাডিসন ব্লু
- হোটেল সরং প্যালেস
জয়পুর এ সাশ্রয়ে মানসম্মত হোটেল বুক করতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই নম্বরেঃ +৮৮০ ৯৬১৭ ১১১ ৮৮৮ অথবা ০১৮৪৭-২৯১-৩৮৮।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
Comment (0)