লালাখাল : নীল জলের নদী –

লালাখাল (Lalakhal) সিলেটের নীলনদ নামে পরিচিত। সিলেট (Sylhet) শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নীলাভ  জলরাশি আর দু’ধারের অপরূপ সোন্দর্য, দীর্ঘ নৌপথ ভ্রমণের সাধ যে কোনো পর্যটকের কাছে এক দুর্লভ আকর্ষণ। তেমনি এক নির্জন মনকাড়া স্থান লালাখাল। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান। সারি নদীর স্বচ্ছ জলরাশির ওপর দিয়ে নৌকা অথবা স্পিডবোটে করে আপনি ঘুরতে পারেন লালাখালে। যাওয়ার পথে আপনি দু’চোখ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন কিন্তু সৌন্দর্য শেষ হবে না। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করার জন্য স্থানটি বেশ উপযোগী। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, নদী, চা-বাগান ও নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার লালাখাল জুড়ে। যদি ভরা পূর্ণিমায় যেতে পারেন তাহলে জ্যোৎস্না ধোয়া নদীর রূপ সারাজীবন মনে রাখার মত একটা ঘটনা হবে। লালাখাল নদীতে অসংখ্য বাঁকের দেখা মেলে। প্রতিটি বাঁকই দেখার মতো সুন্দর।

পাহাড় গুলোকে দেখলে মনে হয়, কেউ যেন নিজ হাতে থরেথরে একের পর একটি করে সাজিয়ে রেখেছে। এখানে পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমা হয়। একটু কাছ থেকে দেখা যায়, মেঘেরা দল বেঁধে পাহাড়ের গায়ে ঠেস লাগিয়ে থেমে থাকে। আবার কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়। কখনো মেঘ বেশি জমা হলে এখানে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। নদী আর পাহাড় মেলবন্ধনে নদীর টলটলে জল আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, এ যেন প্রকৃতির এক মায়াময়ী রূপের বাহানা। নদীর জলে নৌকার ওপর বসে পাহাড় দেখার সৌর্ন্দযই আলাদা। দলবেঁধে এখানে এলে সুবিধা বেশি, কারণ নৌকা ভাড়াটা কমে যায়। ভ্রমণে আনন্দও উপভোগ করা যায় এবং সবাই মিলে হৈচৈ করে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়।

সারিঘাট থেকে লালাখাল জিরো পয়েন্টের দূরত্ব বেশি নয়। পায়ে হেঁটে বা ট্রলার দুইভাবেই জিরো পয়েন্ট যাওয়া যায়। পর্যটকরা সাধারনত জিরো পয়েন্টে পানিতে নেমে থাকে। সন্ধ্যার দিকে নদীতে কোন নৌকা থাকে না, তাই ভ্রমণ বা ঘোরাঘুরি সন্ধ্যার মধ্যেই শেষ করতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় নৌকা ভাড়া নিয়ে যাতায়াত করলে। মাত্র ৪৫ মিনিট যাত্রা শেষে আপনি পৌঁছে যাবেন  লালাখাল চা বাগানের ফ্যাক্টরি ঘাটে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন নদীর স্বচ্ছ অপরুপ পানির দিকে। কি সুন্দর নীল, তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। লালাখালের পানির রঙের জন্য ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পানি কোথাও নীল, কোথাও নীলচে সবুজ আবার কোথাও আকাশী নীল। তবে এই নীল রঙ দেখতে হলে যেতে হবে শীতকালে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ)। বর্ষায় পানি ঘোলা থাকায় দেখার মত কিছু থাকে না। নীল পানি ছাড়াও নদীর দুইপাশে পাহাড়ি বন, চা-বাগান এবং নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি লালাখাল ভ্রমণকে আনন্দময় করে তোলে।

লালাখাল এর দর্শনীয় স্থান

পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, নদী, চা-বাগান ও নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার লালাখাল জুড়ে। পানি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও আপনাকে দেবে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা। লালাখালে গেলে আদিবাসীদের সঙ্গে আপনার সখ্যের সুযোগও থাকছে! সবকিছু মিলিয়ে এলাকাটি পর্যটকদের কাছে বেশ প্রিয়, কাঙ্ক্ষিত ও প্রতীক্ষিত একটি স্থান। সড়কপথ, নৌপথ দুভাবেই যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও নৌ ভ্রমণটা বেশি উপভোগ্য বলে এটাকেই বেছে নেয় অধিকাংশ পর্যটক। নৌপথে যেতে যেতে যেদিকে চোখ যায়, মুগ্ধতায় নেমে আসে মগ্নতা! নিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণের জন্য আপনি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবেন! চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। লালাখাল ভ্রমণের জন্য শীতের প্রথম ভাগটাই উপযুক্ত সময়। চাইলে বৃষ্টির দিনে ভ্রমণ করা যেতে পারে। তবে শীতের সময়টা বেশ নিরাপদ।

আপনি ইচ্ছে করলে সারা দিন লালাখালে কাটাতে পারেন, অথবা দিনের শেষ ভাগটা কাটিয়ে আসতে পারেন। সারা দিনের জন্য গেলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরলে দুই ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। লালাখালের চারপাশে সন্ধ্যার আগমুহূর্তটা আরো অবিস্মরণীয়। ওপরে আলোকিত আকাশ। ক্লান্ত সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশে গাছপালার মধ্যে পাখির কিচিরমিচির। পাহাড় থেকে তিরতির নেমে আসা সন্ধ্যা ।ধীরে ধীরে গোধূলিকেও আঁধার ঢেকে দেয়। ক্রমে চারপাশে নেমে আসে আঁধার। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে লালাখালের স্বচ্ছ নীল জলে। সঙ্গে জ্যোৎস্না রাতে নৌকায় লালাখাল পাড়ি দেওয়ার মজাই আলাদা। তবে সতর্ক থাকতে হবে। আপনি চাইলে আগেভাগে বুকিং দিয়ে রাত কাটাতে পারবেন লালাখালের পাশে সদ্য গড়ে ওঠা একমাত্র রিসোর্টে। রিসোর্টের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাও আছে। স্পিডবোটে লালাখালের নীল জল চিরে এগিয়ে যাওয়াটা আপনার আনন্দ বাড়িয়ে দেবে।

লালাখালের পানি নীল কেনো

লালাখানের অবস্থান ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচে। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে আসা প্রবাহমান পানির সাথে মিশে থাকা খনিজ এবং নদীর তলদেশ কাদার পরিবর্তে বালুময় হওয়ার কারনে পানির রঙ নীল দেখায়।

লালাখাল চা বাগান

খালের যেখানে শুরু,সেখানেই রয়েছে সুন্দর এক চা বাগানসহ ফ্যাক্টরি। বাগানটিও খুব পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর। পাশে পাড়ার ছেলেদের খেলার ফুটবল মাঠে চাইলে জমিয়ে ফুটবল খেলে নিতে পারেন, যদি প্রস্তুতি থাকে। ওখানেই চাইলে ঘুরে আসা যাবে আদিবাসীদের পল্লি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ আপনাকে নিয়ে যাবে অচেনা এক দেশে।

নৌকা ভ্রমন

লালাখালে আপনি নৌকা ভ্রমন করতে পারেন। নৌকা ভাড়া করার জন্য আপনাকে সারিঘাট সেতুতে থামতে হবে। নদীতে ঘুরে আসার জন্য আপনি ১.৫ ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া করতে পারেন তবে এজন্য আপনাকে দরদাম করতে হবে। যদিও এসব স্থানীয় নৌকাগুলো নাজিমগড় রিসোর্টের ব্যাবস্থা করে দেয়া নৌকোগুলোর চেয়ে তুলনামুলকভাবে ভাল তবে নাজিমগড় রিসোর্টের ব্যাবস্থা করে দেওয়া নৌকাগুলোতে আপনি লাইফ জ্যাকেট পাবেন।
এছাড়াও, লালাখালের পানিতে সাঁতার কাটার পাশাপাশি বালিতে শুয়ে আপনি সূর্যস্নান করতে পারেন। অন্যদিকে, পাহাড়ের উপর উঠে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারেন।

ভ্রমণের সেরা সময়  

লালাখাল ভ্রমণের সেরা সময় শীতকাল। বর্ষাকালে লালাখালের পানি খুব ঘোলা থাকে তাই নভেম্বর থেকে মার্চ অর্থাৎ শীতকাল হচ্ছে লালাখাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। লালাখালের বিভিন্ন অংশে নীল, সবুজ এবং স্বচ্ছ পানির দেখা মিলে। শীতের সময় আপনি পাবেন চমৎকার নীল জলরাশি।বর্ষার স্রোত থাকেনা তখন,  তাই পানি শান্ত এবং স্বচ্ছ থাকে। একেবারে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। বর্ষার সময় স্রোতের কারনে হারিয়ে যায় পানির কালার। শীতে বোনাস হিসাবে পাখিও দেখতে পারবেন। চাইলে তামাবিল অংশের স্বচ্ছ পানির সারি নদীর উপর দিয়ে স্পীডবোট বা নৌকায় লালাখালে যেতে পারেন।

ভ্রমণ খরচ

সিলেট শহর থেকে শুধু লালাখালের জন্য মাইক্রোর ভাড়া দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে হবে, গাড়ি নিলে ভাড়া ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে। সারা দিনের প্ল্যান হলে ভোরে সিলেট থেকে রওনা দিতে হবে। তা ছাড়া বাস কিংবা লেগুনায় ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে সারিঘাট যেতে পারবেন। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা আর স্পিডবোটে যেতে চাইলে ভাড়া ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা হতে পারে। নৌযানে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে, ভাড়া একই।

সিলেট থেকে লালাখাল

সিলেট (Sylhet) থেকে লালাখাল যেতে মাইক্রোবাসে ভাড়া লাগবে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা। বাস কিংবা লেগুনায় সারিঘাট যেতে ৪০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হবে। সারিঘাট থেকে স্পিডবোটে যেতে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা লাগবে। সারিঘাট বাজার থেকে লালাখাল ঘুরে বেড়ানোর জন্য ট্রলার রিজার্ভ করতে পারবেন। ঘন্টা প্রতি ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা নিবে। কয়েক ঘন্টার জন্য ঘুরলে খরচ কিছুটা কম হবে। ট্রলার করে ঘুরলে লালাখাল চা বাগান, সুপারী বাগান, আফিফা চা বাগান, লালাখাল জিরো পয়েন্ট সব ঘুরিয়ে দেখাবে। সবগুলো ঘুরে দেখতে ৩ ঘন্টার বেশি সময় লেগে যাবে।

কি খাবেন
এখানে খাওয়ার অনেক সুবিধা আছে তা থাকা সত্ত্বেও সাথে কিছু রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

কোথায় থাকবেন

আপনি চাইলে পারবেন লালাখাল এর পাড়ে রাত কাটাতে। নর্দার্ন রিসোর্ট নামে রিসোর্টটির নিজেদের পরিবহন ব্যবস্থাও আছে।আরেকটি আবাসন ব্যবস্থা হলো নাজিমগড় রিসোর্ট (Nazimgarh Resorts) যা লালাখাল এর খুব কাছে খাদিমনগরে অবস্থিত। আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়া ভাল। নাহলে রিসোর্টে রুম নাও মিলতে পারে। নাজিমগড় রিসোর্টে থাকার জন্য আছে তিন ধরনের ব্যবস্থা। আছে বিশাল টেরেস, ছোট ছোট বাংলো ও বড় ভিলা। একেকটির ভাড়া একেক রকম, তবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পাঁচতারা হোটেলের সমান। আছে স্পা ও পুল, যেখানে দূর করতে পারেন শরীরের অবসাদ। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটি স্থাপনাই গাছপালা-জঙ্গলে ছাওয়া টিলার ধারে। ভিলা, টেরেস বা বাংলোর বারান্দায় বসে হাত বাড়ালেই যেন পাওয়া যায় গাছগাছালির ছোঁয়া। সাধারণ হোটেল-কটেজের চেয়ে নাজিমগড়ে থাকার খরচটা একটু বেশিই মনে হবে। এক রাতের জন্য সবচেয়ে কমদামি ‘প্রিমিয়ার’ কক্ষের ভাড়া পড়বে প্রায় ৭ হাজার টাকা, আর প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটের ভাড়া প্রায় ১৫ হাজার। এক কক্ষে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ ৩ জন, তবে ৮ বছরের নিচের শিশুর জন্য ভাড়া লাগবে না। এ ভাড়ার মধ্যে পাবেন দুজনের সকালের নাশতা।

এ ছাড়া সিলেট শহরে রাত যাপন করে একদিনে মাত্র লালাখাল ঘুরতে পারেন। অথবা বিছনাকান্দি ও জাফলং যেকোনো একটার সঙ্গে মিলিয়ে বিকেলের ভ্রমণটা লালাখালে হতে পারে। সিলেট শহর থেকে বেশ দূর হওয়ায় সন্ধ্যার দিকে নদীতে কোনো নৌকা থাকে না। তাই ভ্রমণ বা ঘোরাঘুরি সন্ধ্যার মধ্যেই শেষ করতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় নৌকা ভাড়া নিয়ে যাতায়াত করলে।

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং।।

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ