বিরিশিরি ভ্রমণ –

বিরিশিরি বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত। সুসং দুর্গাপুর, নেত্রকোনা জেলার উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশের এক জনপদের নাম। যেখানে বয়ে গেছে টলটলে জলের সোমেশ্বরী আর দিগন্ত হারিয়েছে আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড়ে। ছোট্ট একটি জায়গা যার পরতে পরতে জড়ানো সৌন্দর্য। ঢাকা থেকে বিরিশিরির দুরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। বিরিশিরি সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে এখানে পানি নেমে আসে যা প্রবাহিত হয় সোমেশ্বরী নদীতে। বিরিশিরির মূল আকর্ষণ হলো বিজয়পুর চীনামাটির খনি। এর বুক চিরে বয়ে গেছে সবুজ ও নীলচে স্বচ্ছ পানির হ্রদ। বিরিশিরি খুবই সুন্দর একটি গ্রাম। সেখানকার পাহাড় ও তার আশেপাশের সমভূমির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৬০০ মিটার। এ ছাড়াও দেখার মতো আরো রয়েছে রানীখং গির্জা, কমলা রানীর দীঘি এবং সোমেশ্বরী নদী। নেত্রকোনার সেরা দর্শনীয় স্থান হলো বিরিশিরি। সেখানকার অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে। সাদা মাটির এই দেশে দেখা মিলবে চিনামাটির পাহাড়, সোমেশ্বরী নদী, নীলচে-সবুজ পানির হৃদ, গির্জা, পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠিসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। চিনামাটির পাহাড় এবং নীল স্বচ্ছ জলের লেক মূলত একই জায়গায়। চিনামাটির পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় নানান জায়গায় বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখনেই পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে স্বচ্ছ জলের লেক। মূলত সেখানে লেক দুটি। একটি বেশ বড়। আর সেটাতে অনেক পর্যটকই লম্ফঝম্ফ মেরে গোসল সেরে নেন।

বিরিশিরির সৌন্দর্য আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে সব ব্যস্ততা। বিরিশিরির মূল আকর্ষণ হচ্ছে চিনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে জেগে উঠেছে নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ। সাদামাটি পানির রঙটাকে যেন আরো বেশি গাঢ় করে দিয়েছে। তবে বিরিশিরি গিয়েই আপনি এ সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারবেন; সেটা কিন্তু না। এজন্য আপনাকে যেতে হবে আরেকটু দূর বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়ে। বিচিত্রময় সাংস্কৃতিক আবহাওয়া, কংশ-টেপা-সোমেশ্বরীর কাশবন আর দূরে আকাশে হেলান দিয়ে গম্ভীর গারো পাহাড়ের ধ্যানমগ্ন প্রতিকৃতি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সৌন্দর্যপিপাসুদের মন কেড়ে নেয়। বর্ষায় সোমেশ্বরীর তীরবর্তী বিরিশিরির সৌন্দর্য বেড়ে যায় অনেক গুণ।পাহাড় থেকে নেমে আসা উত্তাল ঢলের রুদ্ররূপ বর্ষায় বিরিশিরি ঘুরতে আসা পর্যটকদের দেখায় তার বন্য সৌন্দর্য। বিরিশিরিতে রয়েছে পাহাড়ি কালচারাল অ্যাকাডেমি। এখানকার অধিবাসীদের শতকরা ৬০ ভাগই গারো, হাজং ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর। এখানে আছে টুঙ্কা বিপ্লবের কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ। হাজং ভাষায় তেভাগা আন্দোলনের আরেক নাম টুঙ্কা বিপ্লব। তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি কমরেড রাসমনি সিংহের স্মৃতিভাস্কর আছে এখানে। এখানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় সবাই পাহাড়ি- গারো, হাজং।

বাংলাদেশ অনন্য সুন্দর একটি দেশ যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক দর্শনীয় স্থানজাফলংয়ের স্বচ্ছ পানি কিংবা সেন্টমার্টিনের গভীর নীল পানি অনেকের কাছে পরিচিত। কিন্তু সবুজ নীলের মিশেলে অদ্ভুত-রঙা হ্রদটা কখনো দেখেছেন? যদি না দেখে থাকেন তবে তৈরি হয়ে যান এখনই। শীতের এই শেষ দিকেই বিরিশিরি ঘোরার উপযুক্ত সময়। কারণ অনেকটা পথ মাটির। বৃষ্টির দিন কাদামাটির পথ মাড়ানো ঝামেলার।

বিরিশিরিতে মূলত ঘোরাঘুরির জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। যেমন চিনামাটির পাহাড়, কমলা বাগান, নীল সবুজ জলের লেক, বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের সামনে নৌ ভ্রমণ, বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট, সোমেশ্বরী নদী, আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি এবং রানীখং চার্চ।

বিরিশিরি ভ্রমণে যা যা দেখবেন-

গারো পাহাড়ঃ

গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য ও বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮০০০ বর্গ কিলোমিটার।

সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়িঃ

এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩শ’ ৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ’ গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল দুর্গাপুর। বর্তমানে এটি নেত্রকোনার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তাঁর পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামে এক রাজার শাসনামল থেকে সুসং রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজপরিবারে বিরোধের সূত্রপাত হয়। ফলে এক সময় গোটা রাজ্য চারটি হিস্যায় ভাগ হয়ে যায় এবং চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাড়িগুলো ‘বড় বাড়ি’, ‘মধ্যম বাড়ি’, ‘আবু বাড়ি’ (ছোট অর্থে) ও ‘দু’আনি বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীঃ

দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ড এর পাশেই অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী । এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে।

টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধঃ

সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছু দূর গেলে এম.কে.সি.এম হাই স্কুলের পাশেই চোখে পড়বে স্মৃতিসৌধটি। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণিসিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী ‘মণিসিংহ মেলা’ নামে লোকজ মেলা বসে। ১৯৪৬-৫০ সালে তখনকার জমিদার বাড়ির ভাগ্নে কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে জমিদারদেরই বিরুদ্ধে শুরু হয় টঙ্ক আন্দোলন। টংক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছ দূর গেলে এম.কে.সি.এম হাই স্কুলের পাশে গেলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। মরহুম রাজনীতিবিদ জালাল উদ্দিন তালুকদারের দানকৃত জমিতে এ স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়।

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লীঃ

সুসং দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় যেতে হয় রানিখং গ্রামে। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। রানিখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে।

হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধঃ

দুর্গাপুর বাজার থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাওয়ার পথে কামারখালী বাজারের পাশে বহেরাতলীতে অবস্থিত রাশিমণি এই স্মৃতিসৌধ। সীমান্তবর্তী, গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বগাঝরা’ নামক গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি।রাশিমণি সেই গ্রামেরই একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন।ব্রিটিশ মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।

সাদা মাটির পাহাড়ঃ

দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের শসার পাড় এবং বহেরাতলী গ্রামে সাদা মাটি অবস্থিত। এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধার গুলো দেখতে অত্যন্ত চমৎকার।

সোমেশ্বরী নদীঃ

সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ পানি আর ধুধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় প্রবাহিত একটি নদী। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। ।

কংশ নদীঃ

কংশ নদী ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগের তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এই নদীটির উৎপত্তি।

কমলা রানির দীঘিঃ

বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রানির দীঘি দেখতে পাবেন। দীঘিটি এখন নদীতে বিলীন হলেও এর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

আত্রাখালি নদীঃ

আত্রাখালি নদী সুসঙ্গ দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

কিভাবে যাবেনঃ

মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি দুর্গাপুর যাওয়ার বাস পাবেন। ৫-৭ ঘণ্টার মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিরিশিরিতে। তাছাড়া কমলাপুর থেকে প্রতিদিন রাতে নেত্রকোনার উদ্দেশে ট্রেন ছাড়ে। ট্রেনে নেত্রকোনা পৌঁছে সেখান থেকে বিরিশিরি যাওয়া যায়।

কোথায় খাবেনঃ

খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা নিয়ে আপনাদের একেবারেই চিন্তা না করলেও চলবে। যে গেস্ট হাউস এ থাকবেন তারাই সুলভ মুল্যে ভাল খাবারের ব্যাবস্থা করে দিবে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক/ তালুকদার প্লাজার সামনে অবস্থিত হোটেল শান্ত এবং হোটেল পুস্প তে ভাল মানের এবং সুলভ মুল্যে খাবার পাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেনঃ

দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা হলো ইয়ুথ মেন খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউজ ও কালচারাল অ্যাকাডেমি। এ ছাড়াও দুর্গাপুরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। স্বর্ণা গেস্ট হাউজ, হোটেল সুসং, হোটেল গুলশান ইত্যাদি। এগুলোর ভাড়া খুব কম। এলাকাভিত্তিক বিশেষ খাবার- নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত খাবার বালিশ মিষ্টি খেতে ভুলবেন না কিন্তু।

বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, এই দেশ আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার।। হ্যাপি_ট্রাভেলিং]

ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ